দক্ষিণের মানুষের জন্য আজ ঈদ

পদ্মা সেতু পার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ
পদ্মা সেতু পার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ  © সংগৃহীত

বাংলাদেশ নদী মার্তৃক দেশ। এদেশের নদী যেমন এদেশের মানুষদের পানি দিয়ে সাহায্য করেছে তেমনি সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে অনেকের। তেমনি এক নদী হচ্ছে ‘পদ্মা’। যার অপর নাম ‘কীর্তিনাশা’। এ নদী পদ্মা পাড়ের মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার সাথে কেড়ে নিয়েছে অনেকের প্রাণ। হোক সেটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে কিংবা নদী পাড়ে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে। তবে এখন থেকে আর নদী পাড়ে ফেরির অপেক্ষা করতে করতে করো প্রাণ যাবে না।

শনিবার (২৫ জুন) উদ্বোধন করা হয়েছে বহুল প্রতিক্ষিত দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু। শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতুর উদ্বোধনের মাধ্যমে সারাদেশের মানুষের মধ্যে খুশির জোয়ার বইছে। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের খুশি সবচেয়ে বেশি। তাদের কাছে আজকের এইদিন তাই ঈদের চেয়ে কম না। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন তারা উদযাপন করেছেন ঈদের মতই।

পদ্মা সেতু মানুষের জন্য নদী পরাপার করবে সস্তিদায়ক। লঞ্চ, স্পিডবোট বা নৌকায় নদী পার হওয়া ছিল অনেকটা জীবন হাতে নিয়ে পার হওয়ার মত। কারণ কখন পদ্মা তার ভয়ংকর রুপ ধারণ করে কেবল তারাই বলতে পারবেন যারা এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে নদী পার করেছেন। তেমনি এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন ঊর্মি ইসলাম ইমা।

তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেন, কোরবানি ঈদের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ দিন হবে। সকাল থেকে হু হু করে বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে দুই-একটা দমকা হাওয়া গাছের অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাতাগুলোকেও যেন অকারণ আঘাতে ঝরিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি থেকেই আন্দাজ করা যাচ্ছে খরস্রোতা পদ্মা আজ ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। আমি তখন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করি। কেউ না গেলেও অন্তত আমাকে ঢাকায় ফিরতেই হবে। কাওড়াকান্দি ঘাটে ঈদে গ্রামে আসা ঢাকামুখী মানুষের ঢল। পরিবারের সদস্যের কথা রাখতে যেয়ে সেদিন ঘাটে এসে দ্বিধাদ্বন্দে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফেরিতেই উঠেছিলাম।

তিনি আরো লিখেন, ঈদের সময়টাতে ধারণ ক্ষমতার তুলনায় কখনো চার-পাঁচগুণ কিংবা তারচেয়েও বেশি  যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলোকে দোল খেতে খেতে উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিতে দেখা যেত। আমরা তখন মাওয়া ঘাটের কাছাকাছি। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং। ওই দিকটায় পদ্মা সবচেয়ে ভয়াবহ। যৌবনের সমস্ত শক্তি নিয়ে যেমন দামাল ছেলেরা প্রতিপক্ষের উপর হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে তেমনি এক একটি ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে।

আমার দৃষ্টি আটকে আছে অনতিদূরে দোদুল্যমান অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই একটি লঞ্চের দিকে। ঢেউয়ের সাথে যাথে যেন কয়েক হাত উপর থেকে আছড়ে পড়ছে। কখনো ডানে হেলে যাচ্ছে কখনো আবার বাঁয়ে। দেখতে দেখতেই সকলকে হতবাক করে চোখের পলকে লঞ্চটি পদ্মার বুঁকে হারিয়ে গেল। মিনিট দশেক পর মায়ের নম্বর থেকে কল আসতেই আমার ঘোর ভাঙলো। ওপাশ থেকে ভয়ার্ত উত্তেজিত কন্ঠস্বর। চ্যানেলে চ্যানেলে নাকি ব্রেকিং নিউজ চলছে। শান্তস্বরে বললাম আমরা ঠিক আছি। পনেরো-বিশ মিনিট পর আবার মায়ের কল। এবার ফোন কানে নিতেই মা আর্তনাদ করে উঠলো। ডুবে যাওয়া লঞ্চে আছে আমাদের এলাকার অনেকেই। আছে প্রতিবেশী চাচাতো বোন দুই সন্তানসহ।

তিনি আক্ষেপ করে লিখেন,‘স্বজনহারানো অসংখ্য মানুষকে সেদিন পদ্মা পাড়ের বালুতে ছটফট করতে দেখেছি। আমি, আমরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আজ সেতু হওয়ার আনন্দে সবাই যখন উল্লাস করে, আমি করি আক্ষেপ। সেতুটা সাত বছর আগে না হওয়ার আক্ষেপ। পিনাক-৬ ডুবে যাওয়ার আক্ষেপ। সন্তানহারা প্রতিবেশী বোনের জন্য আক্ষেপ...।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু।

সাবেরা ফারুকি নামের আরো একজন লিখেন, ‘গত দুই বছর আগে আমার আম্মু স্ট্রোক করে। তখন তিনি কলাপাড়া আমার বড়বোনের বাসায় ছিলেন। প্রথমে এলাকার চিকিৎসক হতে ফার্স্ট এইড নিয়ে বরিশাল। ওখান থেকে ঢাকা রেফার করা হয়। এম্বুলেন্সে আমার মা, সাথে আমার দু’বোন, দুলাভাই ও ভাগ্নেজামাই। আমিসহ আমার সেজ বোন দূর থেকে ফোনে কানেক্ট করছি। প্রতিটা মুহুর্ত ছিল হাজার বছরের সমান। বারবার ফোন করে শুনি ফেরিপারের জন্য এখনো ওয়েট করা হচ্ছে।

ফেরিতে এত সময় ওয়েট, রাস্তায় এত সময় কাটছে....আমার মাকে বুঝি আর বাঁচাতে পারবে না, কারন স্ট্রোক করার পর ৪৫ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করলে ভাল হয়,সেখানে বিকালে রওনা করছে আর পরদিন ভোরবেলায় ঢাকাতে! যখন হসপিটালে পৌঁছালো তখন তার সেন্স ছিল মাত্র ৪%। রাতে শুনলাম সেন্স ৪%-৮%। এভাবে ১১দিন হসপিটালে কনটিনিউ করার পর মা আমার না ফেরার দেশে...। ফেরি ঘাটে সময় চলে যাওয়ায় প্রাণটাও চলে গেছে আমার মায়ের।

এমনই আরো না জানা কত সন্তানের হাহাকার রয়ে গেছে সবার অগোচরে। তবে এখন থেকে আর কেউ ফেরি পারাপারে দেরির জন্য তাদের স্বজন হারাবে না। তাইতো পদ্মা সেতুর উদ্বোধন তাদের জন্য ঈদ। ’


সর্বশেষ সংবাদ