নিজেদের খরচ বাঁচিয়ে সাহরি-ইফতার নিয়ে অসহায়দের পাশে তারা
রাজধানীর ওয়ারীর নূর জামে মসজিদের সামনে ইফতারের আগে একটি বড় জটলা। ভিড় ঠেলে সামনে গেলে দেখা গেল একটি টেবিলে ইফতার সামগ্রী নিয়ে দাড়িয়ে আছে কয়েকজন তরুণ-কিশোর। ইফতার নেয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন। আশেপাশের নিম্নশ্রেণীর মানুষ, ভাসমান মানুষ, রিকশাওয়ালা- সবাই দাঁড়িয়েছেন এ সারিতে। সুশৃঙ্খলভাবে তাদের হাতে ইফতার তুলে দিচ্ছেন এ কিশোররা।
তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। নিজেদের খরচ বাঁচিয়ে পরিবার ও পরিচিতদের সহায়তায় রমজান জুড়ে এক হাজার মানুষকে ইফতার ও সাহরি বিতরণ করছেন তারা। এছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় দুইশত নিম্নবিত্ত পরিবারের মাঝে রমজান বাজার পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।
ইফতার নিতে আসা ফুলেলা বেগম ওয়ারী এলাকায় ছাই বিক্রি করেন। ইফতারের আগে তিনি এ এলাকায় খোঁজেন কারা ইফতারি দেয়। তিনি বলেন, ‘‘এখানে প্রত্যেকদিন ইফতারি দেয় তাই চলে এসেছি। আগে মুরব্বিরা ইফতারি দিতো। এখন ছেলেগুলো ইফতারি দেয়। তারা অনেক ভালো।’’
তাদের ইফতার সামগ্রীর মধ্যে আছে খেঁজুর, ছোলা, বেগুনী, আলুর চপ,পিয়াঁজু,পানি আর খিচুড়ি। সাহরিতে মুরগী খিচুড়ী, ডিম খিচুড়ী ও তেহেরী। রমজানের বাজার সামগ্রীতে পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, ৫০০ গ্রাম ডাল, ২ লিটার সয়াবিন তেল, ১ কেজি পিয়াঁজ, ১ কেজি চিনি, ১ কেজি লবণ, ৫০০ গ্রাম ট্যাঙ, হলুদ, মরিচ ও মসলার গুড়া।
রিকশাওয়ালা হারুণ মিয়া ইফতারির আগে রিকশা দাড় করিয়ে এসেছেন এখানে। ইফতারি নিয়ে তিনি বলেন, আমরা গরীব মানুষ। ইফতারির আগেও রিক্সা চালাই। আযান দিলে মসজিদ বা কোন জায়গায় ঢুকে পরি। আজকে এখানে ইফতারি দিচ্ছে তাই এসেছি। এ ধরনের আয়োজন সব জায়গায় হলে ভালো।
মানবতার ডাকে ‘আসুন মানুষের পাশে দাড়াই, ভয় কিসের হেরে যাবে? না! নিজেকে বলুন পারবো।’- স্লোগান নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন ‘পারবো’ নামের ব্যানারে এই তরুণ-কিশোররা। তাদের দাবি সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ ও কিশোরদের নিয়ে সমাজে নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয়েছে। উঠতি বয়সের কিশোর মানেই কিশোর গ্যাং, ইভটিজিং, চাঁদাবাজি নানান অপরাধের পরিচয়।
আর উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোরদের নিয়েও নানান মন্তব্য। এমন পরিস্থিতি কিশোররা শুধু খারাপ কাজ করে না, তারা মানবতার পক্ষে সামাজিক কাজ করে-এই বার্তা দিতেই তাদের এ কার্যক্রম। সাত জন নিয়ে ‘পারবো’ এর কাজ শুরু করলেও এখন সদস্য সংখ্যা ত্রিশ জন। প্রতিদিন ষাট থেকে সত্তর জনের মত স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন তারা।
২০১৯ সালে শীতার্তদের শীতবস্ত্র, ইতিমখানায় খাবার দেয়ার মাধ্যমে সংগঠনের যাত্রা শুরু। করোনার সময় সচেতনতা তৈরি, মাস্ক বিতরণ ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন তারা। গতবছর থেকে মাসজুড়ে আটশত জনের মাঝে ইফতার ও সাহরি বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়।
আরও পড়ুন: ঢাবির জিয়া হলে জেডার ইফতার মাহফিল
এবছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গেন্ডারিয়া, ওয়ারী এলাকায় দুইশত নিম্নবিত্ত পরিবারের মাঝে রমজানের বাজার পৌছে দেয়। এছাড়া জুরাইন এলাকার একটি স্কুলের ছাত্রীদের বিনামূল্যে স্যানিট্যারি প্যাড বিতরণ কার্যক্রম তাদের চলমান। ঈদের পরে পুরান ঢাকায় এলাকা ভিত্তিকি বিনামূল্যে স্যানিট্যারি প্যাড কার্যক্রম চলবে।
রমজান শেষে হলে দশটি পরিবারকে সাবলম্বী করার জন্য ছাগল, সেলায়মেশিন ও দোকান করে দেবে এ কিশোররা। ‘পারবো’-এর কাজ পরিচালনার জন্য সংগঠনের জন্য প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের শিক্ষার্থী সাদেক হোসেন সাফিনের ওয়ারী বাসার নিচ তলার একটি রুম অফিস হিসাবে ব্যবহার করেন।
‘পারবো’ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন ইউনিভার্সিটি লিবারেল আর্ট বাংলাদেশের শিক্ষার্থী তামিম চৌধুরী। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিশোরদের নিয়ে নেগেটিভ ধারণা তৈরি হচ্ছে। কিশোররা নানান অপরাধে জড়াচ্ছে। কিশোরদের নিয়ে এ ধরণের ধারণা পরিবর্তনে আমাদের কার্যক্রম। আমরা আমাদের নিজেদের খরচের টাকা, পরিবার ও পরিচিতদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করি।
‘পারবো’ এর ইফতার সাহরি ও রমজানের বাজার বিতরণের সমন্বয়ক বেলাল আলী খান বলেন, আমাদের লক্ষ্য মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আজকে ওয়ারী ও গেন্ডারিয়ায় ছয়শতো মানুষের মাঝে ইফতার বিতরণ করেছি। রাত বারোটা পরে দুশত ভাসমান লোকের মধ্যে সাহরি বিতরণ করব। প্রত্যেকদিন রাজধানীর ওয়ারী, গেন্ডারিয়া, লহ্মীবাজার, ধানমন্ডী ও মিরপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে আমাদের কার্যক্রম চলে।