দক্ষতা-যোগ্যতা দিয়েই সব সেক্টরে বিচরণ নারীদের
আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ (৮ মার্চ)। নারী অধিকার রক্ষায় বিশ্বব্যাপী সমতাভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে প্রতিবছর এই দিনে দিবসটি উদযাপন করা হয়। জাতিসংঘ এবছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’। এই মূল প্রতিপাদ্যেও আলোকে বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’।
এ উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সারাদেশে শোভাযাত্রা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
লিঙ্গ বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন, নিরাপত্তা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, গুরুত্ব প্রদান বিভিন্নভাবেই নারী কঠিন বঞ্চনা ভোগ করেন। অথচ, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর অবদান অনস্বীকার্য। সভ্যতার পালাবাদলে নারী দেখিয়ে দিচ্ছে তাদের অবস্থান। তবুও তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনো পিছিয়ে আছেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এসে নারীর ক্ষমতায়ানে চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষিকদের ভাবনাগুলো তুলে ধরছেন তানভীর আহম্মেদ-
ক্ষমতায়ন হল একটি প্রক্রিয়া যা শুধু ব্যক্তির নিজের জীবনযাত্রাই নয় তার চারপাশের সমাজ এবং সম্প্রদায়ের ক্ষমতা সৃষ্টি করে। নারী তখনই ক্ষমতাবান হয় যখন তাদের শিক্ষা, পেশা এবং জীবনযাত্রার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তারা তাদের উপলব্ধ সুযোগসমূহ লাভ করতে সক্ষম হয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্যতা পায়। নারী ক্ষমতায়ন নারীর নিজস্ব মূল্যবোধকে বিকাশিত করতে সাহায্য করে। ক্ষমতায়ন আসলে একটি প্রক্রিয়া, কোনো বস্তু নয়। এই প্রক্রিয়ায় নারীরা প্রতিদিনই নতুন নতুন চ্যালেন্জের সম্মুখীন হচ্ছে সাথে সাথে অনেক সম্ভাবনার দ্বার ও উন্মোচিত হচ্ছে। চ্যালেন্জ বলতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ এখনো অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।
নারী শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, তাদের কর্মযোগ্যতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা সম্ভব। এই উন্নয়নের হাত ধরেই সমাজ, জাতি এবং সর্বোপরি দেশের বহনক্ষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
আফসানা কবির দীপ্তি, প্রভাষক, ফার্মেসি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নারীর ক্ষমতায়ন বলতে একজন নারীর জীবনের সকল ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত হওয়ার ক্ষমতাকে বোঝায় । যখন নারীর ক্ষমতায়নের কথা আসে তখন শিক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের মতো বিষয়গুলো সামনে আসে । আজকাল নারীর অংশগ্রহণ সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান কিন্তু খুব কম নারীর মধ্যেই অগ্রগতি দেখা যায়। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণে বাধা, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং নারীবিরোধী মনোভাব । তাছাড়া, মেয়েদের জন্য সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হলেও অনেক পারিবারিক ও সামাজিক বাধার কারণে নারীরা এখনো এগিয়ে যেতে পারছে না। নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়ের একসাথে কাজ করাই আমাদের কাম্য।
মোছা: আরমিনা সুলতানা, সহকারী অধ্যাপক, জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৯৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি নারীদের অবদানকে উৎসাহিত করতে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে সমাজে নারীদের উদযাপনের একটি থিম হয়ে ওঠে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী দিবস পালন করা হয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অর্জনকে চিহ্নিত করতে এবং শিক্ষার্থীদের আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা ও গুরুত্ব বোঝাতে। এক সময় সমাজে নারীদের পারিবারিক বোঝা মনে করা হতো। শত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বর্তমানে নারীরা সশস্ত্র বাহিনী, চিকিৎসা, রাজনীতি, শিক্ষকতা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশায় গর্বের সঙ্গে নিয়োজিত। এটা আমাদের বড় সৌভাগ্যের এবং একই সাথে মহান সম্মানের যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও নারী।আমি মনে করি নারীদের এখন সমানভাবে বিবেচনা করা হয় এবং পুরুষদের সমান সুযোগ দেওয়া হয়। গবেষণা খাতে, নারীরা ক্রমাগত তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করে চলেছেন যদিও এখনও কিছু আর্থ-সামাজিক বাধা রয়েছে। পরিশেষে, আমি সকল নারীকে তাদের ব্যক্তিত্ব ও চেতনা উদযাপনের জন্য নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানাতে চাই।
আরো পড়ুন: শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে ভ্রুক্ষেপ নেই যবিপ্রবির
দীপা রায়, সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নারীর ক্ষমতায়ন নারীদের জীবন নির্ধারণমূলক ক্ষমতায়নের সুযোগ তৈরি করে দেয়, সেই সাথে তার নিজ্বস মূল্যবোধকে বিকশিত করতে সাহায্য করে। নারীর ক্ষমতায়ন মানেই সমাজের উন্নতি। তাই, লিঙ্গসমতা ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত নারী কখনো সমাজের উন্নতি বয়ে আনতে পারবে না।
নারী ক্ষমাতায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নারী বিরোধী নেতিবাচক সমাজ, মনস্তত্ত্ব, উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নারীবিরোধী প্রচারণা। কর্মক্ষেত্রে এবং সামাজিকভাবে যৌন হয়রানী, নারীর প্রতি বৈষম্য মূলক আইন, বাল্য বিবাহ, সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ নারীকে তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাঁধার সম্মুখীন করছে। যদি নারীরা শিক্ষা অর্জনে যথেষ্ট সুযোগ পায় এবং অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট স্বাবলম্বী হতে পারেন তাহলে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারবেন। নারী সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রণয়ন দরকার। কর্মক্ষেত্রে ও রাজনীতিতে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে নারীরা তাদের নায্য অধিকার বুঝে পাবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নারীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন তাই নারীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের ক্ষমতায়নের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং পৃষ্ঠপোষকতা সৃষ্টি করা অতীব জরুরি।
কবিসতারা খাতুন, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়
‘ক্ষমতা’ শব্দটি ছোট হলেও ওজনে অনেক ভারি। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন সৃষ্টি করাটাও সেক্ষেত্রে অনেক কঠিন। আমার কাছে নারীর ক্ষমতায়ন মানে তার বাড়ি, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজের যেকোন স্তরে স্বাধীন ও সুষ্ঠভাবে কাজ করতে পারাকে বুঝায়। নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করতে হলে একজন নারীকে সততা, ধৈর্য্য, অধ্যাবসায়ের সাথে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যাতে সে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সৎ সাহস লালন করতে পারে।
নারী এমন এক সত্ত্বা যাকে জীবনের প্রতিটি পদেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। মানবজীবনের প্রতিটি ধাপে বিভিন্ন দায়িত্বের পাশাপাশি নানারকম বিষয় সুষ্ঠুভাবে পালনের ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা বেঁচে থাকি আমাদের কর্মে। বর্তমানে নারীরা সকল কর্মে নিজেদের দক্ষতার পরিচয় রাখছে। তাদের এই অগ্রযাত্রা সামনের দিনগুলোতে আরো বেশি ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত করবে। তাই আমাদের চেষ্টা থাকা উচিত, নিজের কর্ম এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সততার সাহায্যে নিজেকে এমন স্থানে নিয়ে যাওয়া যেন আমার কর্মই হয় আমার পরিচয়।
ড. সাব্বা রুহী, সহযোগী অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়