ছাত্রদের বাঁচাতে দিয়েছিলেন জীবন, ৫৩ বছরেও মিলল না জাতীয় স্বীকৃতি
‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে আমার গায়ে যেন গুলি লাগে’। বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে কথাটি বলেছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। যাকে ১৯৬৯ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। ছাত্রদের জন্য শিক্ষকের এত বড় ত্যাগ ইতিহাসে বিরল। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার ৫৩তম শাহাদাতবার্ষিকী। প্রতিবছরের মতো এবারও দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে আজও ড. জোহার আত্মদানের জাতীয় পর্যায়ে কোনো স্বীকৃতি মেলেনি।
গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানের মত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন গড়ে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণায় পাক-বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে শিক্ষার্থীরা এ ধারা উপেক্ষা করে প্রধান ফটকের সামনের মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সংবাদে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে প্রধান ফটকে ছুটে যান তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা।
প্রক্টর হিসেবে তিনি ছাত্রদের শান্ত করার ও ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্ররা পিছু হঠতে না চাইলে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী ছাত্রদের গুলি করার নির্দেশ দেয়। তখন তিনি পাক বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, ‘কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে আমার গায়ে যেন গুলি লাগে’। ড. জোহা ডন্ট ফায়ার! ডন্ট ফায়ার! বলে চিৎকার করতে থাকেন। তিনি ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন। কিন্তু প্রক্টরের আশ্বাসে কর্ণপাত না করে বেলা ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন হাদী তার পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। হাসপাতালে নেয়ার পথে ড. জোহা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা আবাসিক হল প্রাঙ্গণে অবস্থিত ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতি ভাস্কর্য রয়েছে। শামসুজ্জোহাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বলা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন ভবনের সামনে তাকে সমাহিত করা হয়। এছাড়া তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।
এই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে প্রতিবছর জোহা দিবসে জাতীয় স্বীকৃতির দাবি উঠলেও পরবর্তী সময়ে এই নিয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। তবে স্বীকৃতি না পাওয়ার জন্য সরকারের অনীহা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভাবকে দায়ী করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগোলিক অবস্থাকেও অনেকেই কারণ হিসেবে মনে করছেন।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও জাতীয়ভাবে ড. জোহার স্বীকৃতি না মেলার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেন।
তিনি বলেন, প্রতিবছরই ১৮ ফেব্রুয়ারি এলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দিনটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবি তুলি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি নিয়ে আমাদের জোরালো কোনও ভূমিকা থাকে না। শহীদ ড. জোহার আত্মত্যাগকে জাতীয় পর্যায়ে খুব ভালোভাবে তুলে ধরতে পারি না। বিভিন্ন সময়ে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তখন তারা জোহা দিবসকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার বিষয়ে সংসদে উত্থাপনের আশ্বাস দেন। তবে ঢাকায় গিয়ে বিষয়টি ভুলে যান তারা। ফলে এ নিয়ে সংসদে কিংবা জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে, এমনটা দেখা যায় না। আমাদের দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে কমিউনিটি রয়েছে, তাদেরকেও এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করতে পারিনি। তাছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ভালো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মাদ মিজানউদ্দিন বলেন, আমরা জাতীয় শিক্ষক দিবসের দাবিটি কেবল ১৮ ফেব্রুয়ারি এলেই তুলি। কিন্তু সারা বছর খোঁজ রাখি না। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানী থেকে দূরের হওয়ায় খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ জোহা স্যার যদি ঢাবির হতেন তবে ৫৩ বছর পর্যন্ত এই দাবি তোলার প্রয়োজন হতো না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দাবিকে একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলিতভাবে জোরালো দাবি তুলতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবেই ড. জোহার জাতীয় স্বীকৃতি মিলবে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ড. শহীদ শামসুজ্জোহার আত্মদানের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়েছে। আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবো। যাতে এই দিনটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণা করে। আমাদের এই একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রয়োজনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলিত প্রয়াস চালাবো।