শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ কি ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে গেছে?
বাংলাপিডিয়ার হিসাব বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এক হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায়। ১৪৯ জন। ইতিহাসবিদরা বলছেন, সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা না করে যদি জনসংখ্যা আর মৃত্যুর হার হিসেবে হিসাব করা হয় তাহলে অন্যান্য ঢাকার বাইরে জেলাগুলোতে আরো বেশি সংখ্যক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন কিন্তু তাদেরকে আসলে সেভাবে স্মরণ করা হয় না।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘অন্যান্য এলাকায় যদি খেয়াল করেন তাহলে সেখানেও অনেক বড় সংখ্যায় মারা গেছে। আমাদের একটু তাদেরও স্মরণ করা উচিত। পুরো বিষয়টা একটু ঢাকা-কেন্দ্রিক হয়ে গেছে।’ বাংলাপিডিয়ার হিসাবে, কুমিল্লায় মারা গেছে ৮৬ জন, যশোরে ৯১, রংপুরে ৭২, দিনাজপুর ৬১, পাবনা ৫৩, ময়মনসিংহ ৭৫, ফরিদপুর ৪৩, চট্টগ্রাম ৬২, খুলনা ৬৫, বরিশাল ৭৫ এবং রাজশাহীতে ৫৪ জনসহ সব মিলিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা এক হাজার ১১১ জন।
আরও পড়ুন- নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের মামলায় ১৩ জনের কারাদণ্ড
তিনি বলেন, ‘আমরা এদেরকে স্মরণ করতে ভুলে গেছি। ওই যে কেন্দ্র আর প্রান্তিকের যে সমস্যা সেটার কারণে। ঢাকা কেন্দ্রিক স্মৃতিচারণটা একটু বেশি হয়।’ তার মতে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সব মানুষের অবদান রয়েছে। তাদের সবাইকে স্মরণ করা উচিত। তাহলেই বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে বোঝা সম্ভব হবে। নির্যাতিত নারীদের কোন দিবস নেই, গ্রামের মানুষের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে, স্মরণ করতে হলে তাদের সবাইকেই স্মরণ করতে হবে। বৈষম্যমূলক স্মরণ সমাজে বিভেদ বাড়ায়।
শুধু স্মরণ নয় বরং স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শহর থেকে লাখো মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সেসময় তাদেরকে যারা আশ্রয় দিয়েছে তাদেরও অবদান রয়েছে যুদ্ধে। তাদেরকেও তেমন তোড়জোড় করে স্মরণ করা হয় না বলে মত দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্ধারণ করে নিয়েছি কে স্মরণযোগ্য, কে স্বীকৃতি যোগ্য।’
আরও পড়ুন- যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
২৬ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন। কারণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনসহ সব ধরণের আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, পাকিস্তান আর্মির প্রধান লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র মানুষ যেমন পিলখানা, রাজারবাগের মতো জায়গাগুলো। তার মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ধরনের আক্রমণ হয়েছিল। একটি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও অন্য জায়গায়। আরেকটি আক্রমণ হয়েছে জগন্নাথ হলে। এ হলের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের উপরও আক্রমণ হয়। জাতিগতভাবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর হামলা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের একটা প্যাটার্ন ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর। তারা কোন একটি জায়গায় গিয়ে যখন কাউকে শত্রু মনে করতো বা ত্রাস সৃষ্টি করতে চাইতো সেখানেই তারা হত্যাকাণ্ড চালাতো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শেষ একটি আঘাত এসেছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরো অনেককে। এরপর তাদের অনেকের লাশ পাওয়া যায় বধ্যভূমিতে, অনেককে আর কখনো খুঁজেই পাওয়া যায়নি। তবে শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয় বরং ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে বাঙালিদের উপর গণহত্যার পর থেকে শুরু করে পরবর্তী ৯ মাস ধরে চলা মুক্তিযুদ্ধ-পুরোটা সময়জুড়েই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন- ‘ঠিকানা না থাকলে চাকরি হবে না, এটা হতে পারে না’
অনেকেই অভিযোগ করেন যে, ঢাকার বাইরে নিহতদের তেমন স্মরণ করা হয় না। এ নিয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন এর আগে বলেন, সুনির্দিষ্ট করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার যে পরিকল্পনা সেটি আল-বদরদের হাতে তুলে দেয়া হয় জুন মাসের দিকে যখন এই বাহিনী গঠিত হয়। এর পর থেকে আল-বদর বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে এবং সঙ্গে অন্যরাও ছিল। ১৬ ডিসেম্বর এসে সবাই বুঝতে পারে যে আসলে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৪ ডিসেম্বরটাকে করা হয়েছে এই কারণে যে, বিজয় দিবস হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ বা সরকার বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের যাদের ৫২ বা ৪৭ থেকে একটা বড় অবদান আছে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত আন্দোলনের, তাদের সম্মান জানানোর জন্য।
কিন্তু এরপরও ১৪ ডিসেম্বরকেই কেন বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করা হলো এমন প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক শামসুল আরেফিন বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। আর সেটি হচ্ছে, আনন্দের দিনের আগে একটি বিষাদময় দিন ছিল। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই দুটি দিনের ঠিক আগের দিনটাতেই হত্যাকাণ্ড চলেছে।
আরেফিন বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা একটা পরিকল্পিত বিষয় ছিল। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় তাহলে এটা যারা পরিচালনা করবে সেই বুদ্ধিজীবীদেরকেই হত্যার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানিদের। বেছে বেছে যখন বেশ কিছু মানুষকে হত্যা করা হলো, আজ পর্যন্ত জাতি এই জায়গা থেকে উত্তরণ করতে পারেনি।
মাখদুমা নাসরীন যিনি একজন চিকিৎসক এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে জাতীয় জীবনে প্রভাব রেখেছে। তবে এতে করে বাংলাদেশে থেমে থাকেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, শূন্যস্থান পূরণের জন্য নতুন প্রতিভা জন্মেছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বেগম রোকেয়া মারা যাওয়ার পর তাকে কলকাতায় সমাহিত করতে দেয়া হয়নি। তাই বলে তার প্রভাব তো আর থেমে থাকেনি নারীদের জীবনে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টিও তেমনি।
বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি এবং তাদের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে খুব বেশি কাজ হয়নি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। আবার অনেকেই মনে করেন যে, এ বিষয়ে কাজ হলেও আসলে সেগুলো একসাথে সংকলিত হয়নি সেভাবে। এ বিষয়ে মাখদুমা নাসরীন বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা হয়েছে এটা সেই ‘৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বরও জানতে পেরেছিলেন তারা। তবে সেটা বিচ্ছিন্ন ছিল।
তিনি বলেন, পুরো চিত্র সামনে আসে আরো অনেক পরে। ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় ফেরার পর ধীরে ধীরে জানতে পারেন তারা। তবে এসব তথ্য সংরক্ষণে এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করেন মাখদুমা নাসরীন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার যেহেতু ৫০ বছর হয়ে গেছে তাই আরো দেরি হলে হয়তো সংরক্ষণের জন্য উপাদান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির চেষ্টা হয়েছে। এগুলোকে একটি সূত্রে নিয়ে এসে পূর্ণাঙ্গ করার পদক্ষেপ নিতে হবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে। সাথে তাদের জীবন বৃত্তান্ত থাকতে হবে যাতে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে।
এ বিষয়ে আরেফিন বলেন, স্মৃতি সংরক্ষণ বা তালিকা নিয়ে কাজ হয়নি তা নয়। তবে সেগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে খুব বড় উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাংলা একাডেমী কথ্য ইতিহাস তৈরির একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সেগুলো সংকলিত হয়নি। এ বিষয়ে সরকারকে বড় উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।