ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে ‘হাফপাস’ আন্দোলন

ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে ‘হাফপাস’ আন্দোলন
ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে ‘হাফপাস’ আন্দোলন  © ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে শিক্ষার্থীরা গণপরিবহণে অর্ধেক ভাড়ার জন্য আন্দোলন করছেন। তবে সরকারি বাস ছাড়া বেসরকারি  কোন বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়ে রাজি নয় মালিক পক্ষ। এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে সন্তোষজনক সমাধান না পেয়ে বেশকিছু দাবিতে আজ রবিবারও আন্দোলন করেছেন তারা। এ আন্দোলন ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।

এদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও লালমাটিয়া এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডি-২৭ রাপা প্লাজার সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এসময় পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যদের আশপাশে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনাকালে পরিবারের উপার্জন কমার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পকেট খরচও কমেছে। নতুন করে বাস ভাড়া বাড়ায় তাদের জন্য বিষয়টি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য নতুন করে ‘দানা বাঁধছে’ আন্দোলন। এরই মধ্যে গেল কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

আন্দোলনগুলোতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাসের স্টাফদের আচরণ। বিভিন্ন স্থানে অসৌজন্যমূলক আচরণ, গায়ে হাত তোলা থেকে শুরু করে যৌন হয়রানির মতো অভিযোগ উঠছে। রাজধানীর বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থী হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় বাসের কন্ট্রাক্টর এক ছাত্রীকে ‘অকথ্য ভাষায়’ গালাগালসহ ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সর্বশেষ কয়েকদিনে গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে (১৫ নভেম্বর) রাজধানীর রামপুরা বিটিভি ভবনের সামনে রাইদা পরিবহনের একটি বাস থেকে ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডায় এক শিক্ষার্থীকে ‘ঘাড় ধাক্কা দিয়ে’ নামিয়ে দেওয়া হয়। গত ১৭ নভেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সাথে বিহঙ্গ বাসের হেল্পার অসৌজন্যমূলক আচরণ করার কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে বাস ভাঙচুর করেন।

১৮ নভেম্বর তিতুমীর কলেজের ৪ শিক্ষার্থীকে মারধরের প্রতিবাদে শনিবার ঢাকা কলেজের সামনে বাস ভাঙচুর করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা অনু বলেন, তার যাতায়াতের রুটে ভিক্টর ক্লাসিক নামের বাসে হাফ ভাড়া নেওয়া হয় না। এমনকি স্টুডেন্ট বুঝতে পারলে মাঝেমধ্যে তুলতেও চান না বাসের স্টাফরা।

আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো

যথাযথ তদন্ত করে শিক্ষার্থী নাঈমকে হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া; জেলা শহরের বিভিন্ন রুটে শিক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু; স্কুল-কলেজের সামনে হর্ন ও ওভারস্পিডিংয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের জরিমানা আদায়ের পাশাপাশি তা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরের অধিকার দেওয়া; সব শিক্ষার্থীর হাফ পাস নিশ্চিত করা; প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একাধিক গতিরোধক তৈরি; শহরের প্রত্যেক অচল ট্রাফিক লাইটের সংস্কারসহ সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা; ট্রাফিক আইনের সঠিক প্রয়োগ; জেব্রা ক্রসিংয়ের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা; চলন্ত বাসে যাত্রী ওঠানামা করালে প্রত্যেক বাসকে আইনের আওতায় আনা এবং নিরাপদ সড়ক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা।

আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ

গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নির্ধারণের প্রজ্ঞাপন জারি করার দাবিতে ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলা হয়েছে। ছাত্রলীগ এ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচির শেষপর্যায়ে দুই দফায় এ হামলা হয়।

শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া চেয়ে রিট

শিক্ষার্থীদের জন্য সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি বাস, লঞ্চ ও ট্রেন ভাড়া অর্ধেক করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ এ রিট করেন।

তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিজেরাও গণপরিবহণে ছাত্র জীবনে অর্ধেক ভাড়া দিয়েছি। এটা একটা ঐতিহ্য। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। এটা বন্ধ করা যাবে না। এটা বন্ধ করা সংবিধানেরও লঙ্ঘন। সরকারকে এখন অর্ধেক ভাড়ার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন করে দিতে হবে।”

হাফ ভাড়ার দাবি সংসদে

সবধরনের গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া প্রচলন করতে জাতীয় সংসদে আইন পাস করার দাবি করেছেন বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা। শনিবার সংসদ অধিবেশনে মহাসড়ক বিল-২০২১ এর সংশোধনের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে রুমিন ফারহানা এ দাবি করেন।

আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলোর সংহতি

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন শীর্ষ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেছেন, পরিবহনে হাফ ভাড়া শিক্ষার্থীদের শুধু দাবি নয়, এটা তাদের অধিকার। ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে আমাদের মৌন সমর্থন রয়েছে।

ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি অনিক রায় বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি আমাদের সমর্থন আছে। সরকারের উচিত প্রজ্ঞাপন দিয়ে হাফ পাশের বিষয়টি সমাধান করা। গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) নিশ্চিত করতে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদও।

আন্দোলনে সরকার এবং বাস মালিক পক্ষের অবস্থান

শিক্ষার্থীদের ‘হাফ ভাড়া’ নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে গতকাল শনিবার মালিক-শ্রমিক সমিতির বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্যাহ জানান, আমরা আমাদের আগের অবস্থানেই আছি। শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার কোনো আইন নেই। আমরা আগে এই সুবিধা দিয়েছি। কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। সরকার চাইলে দিতে পারে। বিআরটিসি বাস আরো বাড়াতে হবে।

বেসরকারি বাসে ভাড়া না কমলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সারাদেশে বিআরটিসির বাসে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আসছে ১ ডিসেম্বর থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে এই সিদ্বান্তে সম্মতি দিয়েছেন।


সর্বশেষ সংবাদ