৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ওএসডি হলেন যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান-সচিব

অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন ও অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজা
অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন ও অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজা  © ফাইল ছবি

প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মাথায় নিয়ে অবশেষে ওএসডি হলেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন এবং সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজা। তাদের দুজনকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের এক মাস পাঁচ দিন পর অবশেষে তারা ওএসডি হলেন।

অন্যদিকে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহা. মোকবুল হোসেনকেও মাউশিতে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। তারা তিনজনই বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা। 

মঙ্গলবার একই আদেশে রাজশাহীর সরকারি এএইচএম কামরুজ্জামান ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক (ব্যবস্থাপনা) মো. আবদুল খালেক সরকারকে যশোর শিক্ষা বোর্ডের সচিব পদে বদলি করা হয়েছে।  এ বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দেওয়া হয়েছে যশোর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আহসান হাবিবকে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৮ অক্টোবর বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিবসহ মোট পাঁচজনের নামে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর গত ২৩ অক্টোবর ধরা পড়ে আরও আড়াই কোটি টাকা জালিয়াতি ও আত্মসাতের ঘটনা। একজন শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততায় এমন বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা সারাদেশে সমালোচনার ঝড় তুলছে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ ঘটনা যশোর শিক্ষা বোর্ডকে শুধু কলঙ্কিতই করেনি, কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর অডিটকালে যশোর শিক্ষা বোর্ডে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের প্রথম ঘটনাটি ধরা পড়ে। সরকারি কোষাগারে জমার জন্য আয়কর ও ভ্যাট বাবদ ১০ হাজার ৩৬ টাকার নয়টি চেক ইস্যু করা হয়েছিল। ওই চেকগুলো জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং এবং শাহী লাল স্টোর নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই বিপুল টাকা আত্মসাৎ করা হয়। দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংক শিক্ষা বোর্ড শাখার এই চেকগুলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার মাধ্যমে পরিশোধিত হয়েছে।

শিক্ষা বোর্ডের ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়-ব্যয় বোর্ডের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলকরণের সময় দেখা যায়, বোর্ডের ব্যয় অ্যাকাউন্ট এসটিডি-২৩২৩২৪০০০০০২৪ হিসাব খাতের নয়টি চেক পরিশোধিত হয়েছে। কিন্তু বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমাণের সঙ্গে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিশোধিত টাকার মিল নেই। এ ধরনের অমিল ধরা পড়ায় হিসাব প্রদান শাখার হিসাব রেজিস্ট্রারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়। বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের নয়টি চেকের তারিখ অনুযায়ী হিসাব শাখায় ব্যয় রেজিস্ট্রারের ব্যয় বিবরণীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য চেকগুলো ইস্যু করা হয়। কিন্তু ইস্যু করা চেকগুলোর বিপরীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে অর্থ পরিশোধিত হয়নি। আসলে নয়টি চেক জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে দুই কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা তুলে নিয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান।

এরমধ্যে ২০২০ সালের ৮ জুলাই আয়কর বাবদ দুই হাজার ৫০০ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেক জালিয়াতি করে ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করে ভেনাস প্রিন্টিং প্যাকেজিং। একইভাবে ২০২০ সালের ১২ আগস্ট ভ্যাট বাবদ এক হাজার ২০৭ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। এরপর ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট আয়কর বাবদ ৬০০ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে শাহী লাল স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করে নেয়। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর আয়কর বাবদ ৬৭৮ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। এই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ২৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করে এই শাহী লাল স্টোর। আবার একই বছরের ১৯ নভেম্বর ভ্যাট বাবদ ৬০০ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। ২০২১ সালের ৬ মে ভ্যাট বাবদ ৯৯৬ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। সেটি জালিয়াতি করে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। যদিও ব্যাংক থেকে পরিশোধিত চেক/অর্থের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান দুটি বোর্ডে কোনো মালামাল বা সেবা সরবরাহ করেনি।

সংশ্নিষ্টরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান বোর্ডে মালামাল সরবরাহের জন্য বোর্ডের সচিব স্বাক্ষরিত কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর কার্যাদেশে উল্লিখিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্টোরে মালামাল সরবরাহ করে বোর্ডের সচিবের কাছে মালামালের চালান ও বিল ভাউচার দাখিল করে। এরপর বোর্ডের সচিব মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য চালান ও বিলের ওপর স্টোরকিপারকে মার্ক করে স্টোরে পাঠান। স্টোরকিপার ওই চালান এবং বিল ভাউচার সচিব স্বাক্ষরিত স্মারকে কার্যাদেশ অনুযায়ী মালামাল বুঝে নিয়ে বিলের জন্য রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিল ভাউচার হিসাব প্রদান শাখায় পাঠান।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে হিসাব প্রদান শাখার কার্যাদেশের মাধ্যমে বিল প্রদান নথি নিরীক্ষা করে দেখা যায়, ব্যাংক থেকে পরিশোধিত অর্থের বিপরীতে কোনো বিল ভাউচার নথিতে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ জালিয়াতি চক্র অন্য বিল থেকে ভ্যাট ও আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার লক্ষ্যে ইস্যু করা চেকগুলোর মুড়ির নম্বরে এবং তারিখের মিল রেখে চেক জালিয়াতি করে বোর্ড তহবিলের টাকা আত্মসাৎ করেছে।

 


সর্বশেষ সংবাদ