০৫ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৫০

দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন বেতন পান বাংলাদেশের শিক্ষকরা

দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন বেতন পান বাংলাদেশের শিক্ষকরা  © সংগৃহীত

দেশের শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বরাবরই উদ্বিগ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নানা উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে। প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম। কিন্তু যেই শিক্ষকরা ক্লাসে শেখাবেন তাদের মান নিয়েই রয়েছে প্রশ্ন। দেশে যাঁরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন তাঁদের অনেকেই আগে থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেন না। আর পেশায় আসার পর যে প্রশিক্ষণ তারা পান সেটাও যথেষ্ট নয়। এ কারণে শিক্ষকদের মানের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। মানের পাশাপাশি আছে সম্মান আর সম্মানীর প্রশ্নও। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, মর্যাদার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান সবার নিচে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকেরা মানে ও গুণে উপেক্ষিতই থাকছেন।

মানের পাশাপাশি আছে সম্মান আর সম্মানীর প্রশ্নও। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, মর্যাদার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান সবার নিচে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকেরা মানে ও গুণে উপেক্ষিত থাকছেন।

আজ মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২১’। ইউনেসকো এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে ‘শিক্ষকরাই শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কেন্দ্রবিন্দুতে’। করোনাকালীন শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষকদেরই মূল দায়িত্ব নিতে বলেছে ইউনেসকো।

শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, মান সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত না করে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চের ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে, শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এই গড় মাত্র ৩৫ শতাংশ। চীন, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে এসব দেশের শিক্ষার্থী সবচেয়ে ভালো করছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, মর্যাদা আছে বলে ভালো শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখাও সহজ হয় এসব দেশে।

শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মান ও মর্যাদা শব্দ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মর্যাদা বেশি থাকলে মানসম্পন্নরা সেই পেশায় আসেন। কিন্তু দেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। মাধ্যমিকের শিক্ষকরা তাঁদের বেতন-ভাতা নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে এখন দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, আর্থিক লেনদেনই এক নম্বর যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার সুযোগ নেই বললেই চলে।

শিক্ষকতা পেশা মোটেই আকর্ষণীয় না হওয়ার কারণে দেশে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও গত ১১ বছরে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বেতনের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে আছেন। বাংলাদেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৫০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। তবে ভারতসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রভাষকের পদ নেই। সহকারী অধ্যাপকই শুরুর ধাপ। বেতন তুলনা ও ক্যারিয়ার সংস্থান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘স্যালারি এক্সপ্লোরার’-এর তথ্য মতে, ভারতে একজন সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৪৭ হাজার ৩০৪ রুপি, সিনিয়র স্কেল প্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপকের ৫৬ হাজার ৪৮০ রুপি, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ সাত হাজার ৭৪৮ রুপি এবং অধ্যাপকদের এক লাখ ১৬ হাজার ৭০ রুপি। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন আরো বেশি।

সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তাঁরা ১৩তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে বেতন পান সাকল্যে ১৯ হাজার টাকা। প্রতিবেশী ভারতে প্রাথমিকের এই পদমর্যাদার শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনের সঙ্গে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। প্রায় সাত হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক সরকারি বেতন পান না।

২০১৮ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের একাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্টে মাধ্যমিকের শিক্ষকদের দুরবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে। সেখানে বলা হয়, ৪০.৮১ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন না। ৫৯.১৯ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন। অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৫.৯৯ শতাংশ শিক্ষক। আর বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র কিনে আনেন ১৪.৮৩ শতাংশ শিক্ষক।

দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড), মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষকদের জন্য ব্যাচেলর ইন এডুকেশন (বিএড) ও মাস্টার্স ইন এডুকেশন (এমএড)। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই।

বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মান ও বেতন

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে ২০১৩ সালে গবেষণা করে ভার্কি ফাউন্ডেশন। গবেষণায় দেখানো হয়, এশিয়ার দেশগুলোর সমাজ কাঠামোয় বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের বৃহৎ সম্মানের চোখে দেখা হয়। তবে পশ্চিমা দেশগুলোয় শিক্ষকদের মর্যাদা এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় কম।

জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষকদের সামাজিক সূচকে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ চীনের সূচক ১০০, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গ্রীস (সূচক ৭৩ দশমিক ৭), তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তুরস্ক (সূচক ৬৮), খারাপ সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে ইসরায়েল (সূচক ২), দ্বিতীয় (ব্রাজিল ২ দশমিক ৪), তৃতীয় চেক প্রজাতন্ত্র (১২ দশমিক ১)।

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার বৈশ্বিক সূচক

 

সবচেয়ে বেশি বেতনধারী সূচক ১৫০ এর মধ্যে এগিয়ে লুক্সেমবার্গ। দেশটির সূচক ১৩৭। তার মানে লুক্সেমবার্গের শিক্ষকরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর শিক্ষকের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বেতন পান। বেতনের দিক থেকে এগিয়ে থাকা দ্বিতীয় দেশ সুইজারল্যান্ড (সূচক ১০৭), তৃতীয় অবস্থানে জার্মানি (সূচক ৮৯)। সবচেয়ে নিম্ন বেতন প্রদানকারী দেশ স্লোভাকিয়া। ১৫০ এর মধ্যে দেশটির সূচক ১৯। নিম্ন সূচকে দ্বিতীয় অবস্থানে চেক প্রজাতন্ত্র (সূচক ২২), তৃতীয় দেশ পোলান্ড (সূচক ২৬)।

শিক্ষকদের বেতনের বৈশ্বিক সূচক

 

গবেষণা চালানো প্রতিষ্ঠান মূলত শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করে। ২০১৩ সালে তারা বিশ্ব শিক্ষক পুরস্কার চালু করে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০ হাজার আবেদনকারী আবেদন করেন। এরপর তাদের প্রোফাইল বিবেচনা করে ৫০ জন শিক্ষকের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। এরপর তালিকায় এগিয়ে থাকা ১০ জন শিক্ষকের নাম ঘোষণা করা হয়। সবশেষে একজন শিক্ষককে পুরস্কৃত করা হয়। যার আর্থিক মূল্য ১ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮০ লাখ টাকা)।