ব্যবসায়ীদের মুনাফার অতিলোভে চালের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে: খাদ্যমন্ত্রী
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘ফরিয়াদের মিলে ঢোকার প্রবেশাধিকার নাই। ব্যবসায়ীদের মুনাফার প্রতি অতিলোভের কারণে মাঝে মাঝেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটে থাকে। বাজার মনিটরিংয়ের জন্য মূল্য কমিশন গঠন করে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সরকার ধানের যে দাম নির্ধারণ করেছে তাতে করে মোটা চালের দাম ৪১ টাকার মতো হতে পারে। ন্যায্যমূল্য পাওয়া কৃষকের অধিকার।’
বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ আয়োজিত ‘খাদ্য উৎপাদন, আমদানি ও বাজার পরিস্থিতি: প্রেক্ষিত খাদ্য অধিকার’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাব নেই। তবে অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ তথ্য না থাকার কারণে বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়, যার দায় মন্ত্রণালয়ও এড়াতে পারে না। কৃষিজমির বাণিজ্যিক ব্যবহার বা শ্রেণি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারে কৃষি মন্ত্রণালয়। বাজার মনিটরিংয়ের প্রধান ভূমিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের, খাদ্য মন্ত্রণালয়ও তা করে থাকে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মূল ভূমিকা সরকারিভাবে খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে, বিশেষত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির ক্ষেত্রে।
এছাড়াও মাঠ পর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষি সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করার প্রতি জোর দেওয়ার তাগিদও দেন তিনি।
ওয়েবিনারে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে এবং খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশের দেশীয় অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ।
ভার্চুয়াল এই ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক বণিক বার্তার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাহানোয়ার সাইদ শাহীন।
অতিথির বক্তব্যে ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে এবং আমদানিও কম করতে হচ্ছে। গম উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কম হওয়ায় প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করতে হয়। ২০১০ সাল থেকে আমরা খাদ্যে অর্থাৎ চালে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে যাচ্ছি। তারপরও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের চাল আমদানি করতে হয়। যদিও বাজারে অদৃশ্য হাতের কারণে মাঝে মাঝে দাম বৃদ্ধি পায়, সংকট সৃষ্টি হয়। এজন্য সরকারকে মজুদ বৃদ্ধি করতে হবে, কখনই সাড়ে ১২ লক্ষ টনের নিচে তা হতে দেয়া যাবে না। এজন্য মূল্য কমিশন গঠন করতে হবে। বর্তমানে খাদ্য উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ২.৮ শতাংশ। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে ভিশন ২০৫০ প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০৫০ সালে চালের উৎপাদন হবে ৫৩.৪২ মিলিয়ন টন।
তিনি আরও বলেন, ২০৩০-এর মধ্যে আমাদের দ্বিগুণ ধান উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন ধানের জাত দ্রুত সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সকলের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে হলে খাদ্য অপচয় রোধের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের দেশীয় অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে সাফল্য এসেছে কারণ সরকার কৃষি-গবেষণার ক্ষেত্রটিতে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছে। এটাকে অব্যাহত রেখে দেশীয় সম্পদকে ব্যবহার করে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে কী করা যেতে পারে সে ব্যাপারেও গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে। এটা গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, কৃষক ও ভোক্তাও এতে উপকৃত হবে।
তিনি আরও বলেন, বাজারে আমরা খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। দেশের বড় ৫০টি অটো রাইস মিলের হাতেই থাকে বেশিরভাগ চালের মজুদ। ফলে প্রচলিত আইন না ভেঙেই তারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ফলে এ মজুদ আইনের সংশোধনের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রণয়ন করতে হবে খাদ্য অধিকার আইন।
সভাপতির বক্তব্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, খাদ্য উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসডিজি বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে শুধু খাদ্য নয়, সকল বিষয়েই তথ্য নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে, সেটি দূর করার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। কোভিডকাল উত্তরণে কৃষিখাতই আমাদেরকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছে। কৃষি গবেষণার ফলে বেশকিছু উদ্ভাবনও হয়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। শুধু মূল্য বেঁধে দিয়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে নতুন কিছু ভাবতে হবে। মূল্য কমিশন গঠন হলেও তাদের সুপারিশ যথাযথভাবে হবে, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এছাড়াও ফোরামের পক্ষ থেকে দ্রুতই মন্ত্রীর কাছে খাদ্য অধিকার আইনের একটি খসড়া প্রস্তাবনা প্রদান করা হবে বলেও জানান তিনি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সাহানোয়ার সাইদ শাহীন বলেন, খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে আমাদের মোট কৃষিজ জমির ৭৪.৮৫ শতাংশে ধান উৎপাদিত হয়। মোট ধান উৎপাদনের মাত্র ৬ শতাংশ সরকার মজুতের সক্ষমতা রাখে। এসময় তিনি বেশকিছু সুপারিশমালা তুলে ধরেন।
সেগুলো হলো:
১. কৃষকের নিকট থেকে সরাসরি ৫০ লাখ টন ধান কেনার ঘোষণা ও তা দ্রুত বাস্তবায়ন।
২. ধান ও চাল সংগ্রহ পদ্ধতির আধুনিকায়ন এবং কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ রক্ষায় সরকার কর্তৃক মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি বাড়ানো।
৩. প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য সরাসরি কৃষি উপকরণ (বীজ, সার, সেচ সুবিধা ইত্যাদি) সহায়তার পাশাপাশি কৃষকদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করতে প্রান্তিক পর্যায়ে বিপণন ব্যবস্থপনাকে শক্তিশালী করার অংশ হিসাবে কৃষি বাজার স্থাপন।
৪. কৃষকের উৎপাদিত ফসল, প্রাণী ও মৎস্যসম্পদসহ ফল এবং সকল কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে স্থায়ী ‘মূল্য কমিশন’ গঠন।
৫. কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৬. সরকারিভাবে শস্য গুদাম ও মজুদাগার ২১ লাখ টন থেকে ৬০ লাখ টনে যা ২০২৫ সালের আগেই ১ কোটি টনে উন্নীত করা, পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে কমিউনিটি ভিত্তিক শস্যভান্ডার গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ।
৭. কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ (শস্য রোপন, কর্তন, মাড়াই) এবং ক্ষুদ্র ও বর্গাচাষীদের এ সুবিধা দিতে ভাড়া ভিত্তিক যন্ত্রের ব্যবস্থা করা ও যান্ত্রিকীকরণ খাতে ভর্তূকি বৃদ্ধি।
৮. একই শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানি বন্ধ করা। যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হচ্ছে সেগুলো আমদানি বিষয়ে কৃষক বান্ধব যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
৯. নীতি গ্রহণ ও মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রমের মধ্যে কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি।
১০. উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য কৃষক পর্যায়ে কৃষি উপকরণের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী-র্কমর্কতাদরে র্কাযকর ভূমিকা নিশ্চিতকরণ।
১১. নিরাপদ খাদ্য ও কৃষির জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূল ও বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশব্যাপী কৃষি ক্ষেত্রে যে ধরনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যত দুর্যোগের আশংকা দেখা যাচ্ছে সে অনুসারে গবেষণা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দেশেরে দরদ্রি জনগোষ্ঠীসহ সকল মানুষরে খাদ্য অধকিার প্রতষ্ঠিায় খাদ্য মন্ত্রণালয় র্কতৃক সংশ্লষ্টি সকল পক্ষকে নিয়ে ‘খাদ্য অধকিার আইন’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নরে উদ্যোগ গ্রহণ।