১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৩৬

স্কুলে ফিরবে বাচ্চারা, উদ্বেগ কাটছে না অভিভাবকদের

দীর্ঘদিন পর আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুখরিত হবে শিশু-কিশোরদের কলকাকলিতে  © ফাইল ফটো

অবশেষে ৫৪৪ দিন পর খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমায় আগামীকাল রবিবার (১২ সেপ্টেম্বর) খুলছে স্কুল-কলেজ। আবারও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে দেশের প্রতিটি বিদ্যাপীঠের আঙ্গিনা। সরকারের নির্দেশনায় এরই মধ্যে প্রস্তুত সংশ্লিষ্ট এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে বন্যা কবলিত এলাকা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।

দীর্ঘদিন পর আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুখরিত হবে শিশু-কিশোরদের কলকাকলিতে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে উচ্ছ্বাস যেমন আছে তেমনি আছে স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগও কাজ করছে অভিভাবকদের মধ্যে।

এদিকে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেলে প্রয়োজনে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। আজ শনিবার দুপুরে জামালপুর সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান করলে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা কম। আশা করছি, সংক্রমণ বাড়বেও না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। তারপরও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তারপরও যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়, সেটা করতেও আমরা দ্বিধাবোধ করব না।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কয়েক ধাপে এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর পর চলতি বছরের ২৩ মে থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে বলে গত ২৫ মার্চ জানান শিক্ষামন্ত্রী।

তবে, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে সেই ছুটির মেয়াদ আরও কয়েখ দফায় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট এক ঘোষণায় প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ২৩ দফায় এই ছুটি বেড়েছে।

এদিকে, গত ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে পঞ্চম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস প্রতিদিন হবে। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি এবং ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে সপ্তাহে একদিন করে ক্লাস হবে।

পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) থেকে আলাদাভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনাসহ বেশকিছু সতর্কতা ও সচেতনতামূলক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

এদিকে দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হওয়ায় নানা ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সারাদেশের স্কুল-কলেজগুলো। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের বরণ করতে নানা আয়োজন শুরু করেছেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিন শ্রেণিকক্ষে কার্যক্রম শুরু করার সার্বিক প্রস্তুতি পরিদর্শনে যাবেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আগামীকাল সকাল ১০টায় রাজধানীর আজিমপুর গার্লস স্কুল ও কলেজে যাবেন। তারপর তিনি কলা বাগান লেক সার্কাস স্কুলে যাবেন বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এ অবস্থায় এক দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খোলার প্রস্তুতি চলছে, অন্য দিকে অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরাম নামে অভিভাবকদের একটি সংগঠন। সংবাদ সম্মেলনে শিশুদের করোনার টিকা নিশ্চিত করার পরেই স্কুলে পাঠানোর দাবি করা হয়।

সংগঠনের যুগ্ন আহ্বায়ক মঞ্জুর সাকলায়েন বলেন, আমরা চাই আমাদের বাচ্চাদের টিকা নিশ্চিত করতে। আমরা স্কুলে খুলে দেয়াকে স্বাগত জানাচ্ছি। তবে এটা এক ধরনের ম্যাসাকার (বড় ভুল) হবে যদি তাদের টিকার আওতায় না নিয়ে আসা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল খুলে দেয়ার পর একদিনের আড়াই লাখ বাচ্চা আক্রান্ত হয়েছে।

মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া শাহরিয়ার কবিরের মা রেহেনা খানম বলেন, স্কুল খুললেও বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবো না। দেশে করোনার প্রকোপ একটু কমলেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাই কোথা থেকে কী হয়ে যায় বলা যায় না! একজনের হলেই সবাই আক্রান্ত হবে। কিছুদিন দেখবো, তারপর যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে তারপর স্বিদ্ধান্ত নেব।

চট্টগ্রামের স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী সোমাইয়া আক্তারের মা তাহমিনা আক্তার বলেন, করোনার বন্ধে বাসায় সন্তানদের একদম পড়াশোনা হয়নি। স্কুল খুললে সহপাঠীদের সাথে দেখা হবে। দেড় বছর বন্দি জীবন ছিল, এক ধরনের আতঙ্কে থাকত। এখন ক্লাসে গেলে স্বাভাবিক জীবনটা ফিরে পাবে সন্তানরা।

রাজধানীর স্কুল-কলেজের অভিভাবকদের সংগঠন ‘অভিভাবক ঐক্য ফোরামের’ সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সরকারকে স্বাগত জানায়। তবে একইসঙ্গে আমাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বিরাজ করছে।

তিনি বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাবো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও আশা করি সরকার যে নিদের্শনা দিয়েছে তার মেনে সন্তানদের পাঠদান করাবেন। আর যেসব প্রতিষ্ঠান করবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলবো।  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দঘন পরিবেশে পাঠদান হবে। আর শিক্ষকরা সন্তানদের বরণ করে নিবে।

গত ৫ সেপ্টেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী। একইদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি হিসেবে ১৯টি নির্দেশনা জারি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এসব নির্দেশনার আলোকেই প্রস্তুত করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।

১৯ দফা নির্দেশনা হলো—
*শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশ মুখসহ অন্যান্য স্থানে কোডিড-১৯ অতিমারি সম্পর্কিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে করণীয় বিষয়গুলো ব্যানার বা অন্য কোনো উপায়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে;

*শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথে সব শিক্ষক-কর্মচারী শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা ও তা পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে;

*শিক্ষার্থীদের ভিড় এড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের সবগুলো প্রবেশমুখ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা। যদি কেবল একটি প্রবেশমুখ থাকে সেক্ষেত্রে একাধিক প্রবেশমুখের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে;

*প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পরিবেশে শ্রেণি কার্যক্রমে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করবে এবং বাসা থেকে যাওয়া-আসা করবে সে বিষয়ে শিক্ষণীয় ও উদ্বুদ্ধকারী ব্রিফিং দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া ভিডিও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে;

*প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ আইসোলেশন কক্ষ হিসেবে প্রস্তুত রাখতে হবে:

*প্রতিষ্ঠানের সব ভবনের কক্ষ, বারান্দা, সিঁড়ি, ছাদ এবং আঙ্গিনা যথাযথভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে;

*প্রতিষ্ঠানের সব ওয়াশরুম নিয়মিত সঠিকভাবে পরিষ্কার রাখা এবং পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে;

*প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী এবং অভিভাবক প্রবেশের সময় সরকার দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করতে হবে।

*প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীর সঠিকভাবে মাস্ক (সম্ভব হলে কাপড়ের মাস্ক) পরিধান করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে;

*প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্থানে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দ্বারা হাত ধোয়ার এমন ব্যবস্থা করা যাতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ঢোকার আগে সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুঁতে পারে;

*শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পারস্পারিক ৩ (তিন) ফুট শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে;

*শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ, ড্রেন ও বাগান যথাযথভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা এবং কোথাও পানি জমে না থাকে তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

*প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা নিরুপণ করতে হবে।

*প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

*স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে।

*প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত মেরামত, বৈদ্যুতিক মেরামত এবং পানি সংযোগজনিত মেরামত সম্পন্ন করতে হবে।

*প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকদের সাথে সভা করে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।