২৪ আগস্ট ২০২১, ০৯:৫৬

পরিবারের বোঝা না হতে কাজের দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা

শিশুশ্রম  © ফাইল ছবি

মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে গত প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে মানসিক দুচিন্তা, পারিবারিকভাবে বিভিন্ন চাপ, আর্থিক ক্ষতিগ্রস্তসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

তবে বর্তমানে অনেকটা কূল হারিয়ে পরিবার ও সমাজের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তারা। অনেকেই দৈন্যতার সময় পরিবারের বোঝা না হতে শিক্ষার্থীরা শ্রমের পথ বেছে নিচ্ছেন। এসব শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন। তারা ছাত্রজীবনে আর ফিরবেন কিনা তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সংশয়।

শ্রমে ব্যস্ত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই অসচ্ছ্বল পরিবারের সন্তান। কারও বাবা ভ্যানচালক, কারও বাবা বর্গাচাষি, কারও বাবা দিনমজুর। আবার অনেকেই তিন বেলার খাবার জোগাড় করতে পারে না। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, কবে খুলবে তাও অনিশ্চিত। পড়াশুনা শেষে চাকরি হবে কিনা তা নিয়েও অনিশ্চয়তা। তাই শ্রমের দিকে যেতে উৎসাহ দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা।

পঞ্চগড়ের একটি ফাজিল (স্নাতক) মাদ্রাসা  থেকে অটোপাশের মাধ্যমে নবম শ্রেণিতে উঠেছেন সুমন ইসলাম। সুমন বলেন, ‘আমাদের পরীবার সচ্ছল নয়। করোনার কারণে আরো অসচ্ছল হয়ে পড়েছি। তাই কাঠমিস্ত্রির কাজ শুরু করেছি। বাবা-মা কষ্ট করে পড়াশোনা করাতো। টাকা না থাকায় নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি। পড়াশোনার এখান থেকেই হয়তো ইতি টানতে হচ্ছে।’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আরকে রাজু বলেন, ‘করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর ক্যাম্পাস বন্ধ। বাড়ি থেকে কিছু করার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। আগে টিউশনি করে নিজের খরছ চালাতাম। কিন্তু স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় টিউশনিটাও চলে গেছে। আমরা অপূরনীয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি যা পূরণ হওয়ার নয়। অন্যদিকে বাড়িতে আম্মা অসুস্থ। আগামী মাসে পরীক্ষা না হলে যেকোন কাজ শুরু করে দিব। পড়াশুনা হয়ত এখানেই। শেষ হয়ে যাবে।’

ঢাকা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইফুল বলেন,‘কলেজ বন্ধ থাকায় বাড়িতে আছি। প্রতিদিনই পিতা-মাতা কাজে যেতে বলেন। তাই বাধ্য হয়ে কাজ যেতে হচ্ছে। এখন রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। কলেজ খোলা থাকলে হয়ত কাজে যেতে হতনা। তবে হয়ত আর কলেজ যাওয়া হবে না।’

সাতক্ষীরা সদরের রিয়াজুল ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সম্প্রতি একটা মোটরভ্যান কিনেছে সে। ভ্যাান চালিয়ে উপার্জন করছে সে। তিনি বলেন, বয়স যখন ৫ বছর তখন আমার বাবা মারা যায়। পরবর্তীতে মা মাঠে কাজ করে পরিবারের সংসার চালান। সেই সাথে চলতো তার লেখাপড়া। রিয়াজুল বর্তমানে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় ধীরে ধীরে কাজে ঢুকে পড়েছে। আগে যে সময় প্রত্যহ স্কুল যেতো ছেলেটি, সেসময় এখন সে ভ্যাান চালিয়ে উপার্জন করছে।

ইসালামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের ছাত্র ইউসুফ কাপড়ের ব্যবসা করছেন। ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আলিম তাঁর এলাকায় গড়ে তুলেছেন ফাস্ট ফুডের দোকান। ল অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান নুর ছুটির প্রথম কয়েক মাস একটি মোবাইল কম্পানির শোরুমে চাকরি করেন। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফি করেন। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন নিজ এলাকায় টিউশনির পাশাপাশি বাবার মৌসুমী ফসলের ব্যবসা ও কৃষিকাজ দেখাশোনা করেন। এরকম হজারের ও অধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত।

পরিসংখ্যান বলছে, জীবনের অনিশ্চয়তা, পারিবারিকভাবে চাকরির চাপ, সামাজিকভাবে ব্লেইমসহ অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী অভাবের কারণেও আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। এছাড়া করোনাকালে উঠতি তরুণরা অনলাইন গেমে আসক্ত হওয়া, মাদকদ্রব্য সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এভাবে আরও কয়েকমাস বন্ধ থাকলে শ্রমে ব্যস্ত এসব শিক্ষার্থীদের আর ক্লাসে ফেরানো যাবে না বলে ধারণা গবেষকদের। বাড়তেই থাকবে কাজ করা এসব শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। করোনাকালে অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে শিক্ষার্থীরা যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই। যথাযথ উদ্যেগ গ্রহণ না করলে বাঙালি জাতি যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সপ্ন দেখে তা অধরায় থেকে যাবে।

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনাসহ মানসিক ও শারীরিকভাবে শিক্ষার্থীদের সুস্থ ও সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা এবং যোগ্য করে তোলার জন্য নানা পদক্ষেপ সরকারকে গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করছেন দেশের গবেষক ও শিক্ষাবিদরা।