করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষায় ব্যয় কমেনি
করোনার প্রকোপে গত ১৭ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষায় ব্যয় কমেনি। স্কুল-কলেজে না গিয়েও শিক্ষার্থীদের বেতন ঠিকই দিতে হচ্ছে। এছাড়া করোনায় শিক্ষা অনলাইনমুখী হওয়ায় অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি (ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সংযোগ, কম্পিউটার) ক্রয় করতেও বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। তবে করোনায় পড়াশোনার স্বাভাবিক অগ্রগতি না থাকলেও পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হোম টিউটরের খরচ চালাতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে।
এছাড়া অ্যাসাইনমেন্ট করতেও শিক্ষার্থীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। একদিকে জীবন-জীবিকার লড়াই অন্যদিকে শিক্ষায় ব্যয় বৃদ্ধি ফলে আর্থিক টানাপোড়েনে অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে কিংবা পড়াশোনার ভেতর থাকতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এতে গ্রামাঞ্চল ও শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থীর ঝড়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার যে ব্যয় এটি বহন করা অনেক বাবা-মায়ের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছেনা। করোনার কারণে আয় কমে গেছে এবং নির্ধারিত বেতন থাকলেও ব্যয় বেড়েছে। যেহেতু অভিভাবকদের আয় অনেক ক্ষেত্রে কমে গেছে তাই সরকারের ব্যয় ভার বহন করতে পারছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়া, মেয়েদের বাল্যবিয়েসহ নানান নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমন পরিস্থিতি যে শুধু আমাদের দেশে তা কিন্তু নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে আমাদের দেশের কোন অঞ্চলে বা এলাকায় কতজন শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই তথ্য-উপাত্ত বের করে ব্যবস্থা নিতে পারলে সংকটময় পরিস্থিতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সরকারি মিরসরাই মারুফ মডেল হাই স্কুল পড়ুয়া এসএসসি পরীক্ষার্থী কাজী আজিজুর রহমান বলেন, করোনায় ব্যয় বাড়লেও শিক্ষার অগ্রগতি হচ্ছেনা। ফলে হতাশা বাড়ছে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও এখন ও হয়নি। অনিশ্চিত শিক্ষায় ব্যয় বৃদ্ধি হওয়ায় অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে।
শিক্ষার্থীর মা জবা নুর বেগম বলেন, আমার ছেলের এসএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো এবছর ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু এখনো তা হয়নি। নিয়মানুযায়ী এখন সে কলেজে ওঠার কথা৷ কিন্তু করোনার কারনে সে এখনো এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে এই বাড়তি সময়টাতে তার জন্য হোম টিউটর রাখতে বাধ্য হচ্ছি। যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত বাড়তি খরচ। করোনায় অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও পড়াশোনার খরচ যোগাতে আমার মতো অনেক পরিবারকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী শেখ মাইনুর রহমান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার আগেই আমাদেরকে সেশনজটে পড়তে হয়েছে। যার কারণে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের যে খরচটুকু হবার কথা তার চেয়ে এখন বেশি খরচ হচ্ছে। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, মহামারী আসার পর অনেক পরিবারে আয়-রোজগার কমেছে, যার ফলে এই সময়ে অনেক সন্তানের পড়ালেখার খরচ অভিভাবকরা যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
“এতদিন উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে থাকার ফলে ভর্তি প্রস্তুতির জন্য নতুন বই, কোচিং ফি ইত্যাদি ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে গেছে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এগুলো অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। আগামী বছরের আগে যদি আমরা স্নাতক পর্যায়ে না যেতে পারি, ভবিষ্যতে আমাদেরকে দ্বিগুণ বা আরও বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হবে।”
রংপুর সরকারি সিটি কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী জান্নাত জাহান জুলি বলেন,করোনাকালে বর্তমান শিক্ষা এখন অনলাইনমুখী। অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ব্যয় আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়েছে। অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে প্রয়োজন একটি স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা। আমাদের দেশের অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানের অনলাইনে পড়াশোনার জন্য স্মার্টফোন ক্রয়, ইন্টারনেট খরচ বহন করার মতো সাম্যর্থ এ দেশের হাজারো বাবার নেই। অনলাইনে ক্লাস চলা সম্ভব হলেও সম্ভব হচ্ছে না পরীক্ষা নেয়া। ফলে বছর পেরিয়ে গেলেও একই শ্রেণীতে থাকতে হচ্ছে,তাই খরচ আরো বেড়ে যাচ্ছে।
“এছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দুশ্চিন্তা অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম। অ্যাসাইনমেন্ট করার জন্য A4 সাইজের পেপার বাধ্যতামূলক করায় শিক্ষার খরচ আরো একধাপ বেড়ে গেছে।এসব অ্যাসাইনমেন্টের খুব সহজেই ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহার করে লিখছে শিক্ষার্থীরা। এতে মেধার মূল্যায়নের চেয়ে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি বরং কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো. তৌহিদুল মাওলা বলেন, স্কুল-কলেজের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের হোম টিউট সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু করোনায় দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, দফায় দফায় লকডাউন ও মানুষের আয় কমে যাওয়ায় টিউশন যেন এখন 'সোনার হরিণ'। অনার্স পড়ুয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী টিউশন করিয়ে নিজেদের পড়ার খরচ চালায়, এমনকি পরিবারেও অবদান রাখে। কিন্তু টিউশন না থাকায় এখন জীবন-যাপন অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।এমন অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আর্থিক অবস্থা দিন দিন আরো অবনতি ঘটবে। তাই দায়িত্বশীলদের যথাযত উদ্যোগে অনতিবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করে দিতে হবে।
চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো.মেহেদী হাসান বলেন, ক্লাস-পরীক্ষা কিছুই যথাসময়ে না হওয়ার বাড়তি খরচ টানতে হচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষা এপ্রিলে হওয়ার কথা থাকলেও করোনায় তা হয়নি। এখন আবার চলছে অ্যাসাইনমেন্ট কাকর্যক্রম। সেখানেও একটা খরচ রয়েছে। অনলাইন শিক্ষায় বাড়তি খরচ হলেও শিক্ষার আসল গতি হচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে অনেক শিক্ষার্থী হয়তো আর ক্লাসে ফিরবে না।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি যৌথ গবেষণা বলছে, করোনাকালে শিক্ষার ব্যয় গ্রামীণ পরিবারে ১১ গুণ ও শহুরে পরিবারে ১৩ গুণ বেড়েছে।এপ্রিল ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ সাল পর্যন্ত গত এক বছরের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, করোনার অধিকাংশ পরিবারে আয় কমে গেছে এবং নির্ধারিত বেতন থাকলেও ব্যয় বেড়েছে। যেহেতু অভিভাবকদের আয় অনেক ক্ষেত্রে কমে গেছে, সরকারের ব্যয় ভার বহন করতে পারছেনা। ফলে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়া, মেয়েদের বাল্যবিয়েসহ নানান নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এমন পরিস্থিতি যে শুধু আমাদের দেশে তা কিন্তু না। এটি কি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ঝড়ে পড়াটা কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও ঘটেছে। তবে তারা বিশেষ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে তা মোকাবিলায় কাজ করছে। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে আমরা অনুমান করতে পারছি শিক্ষায় বিরাট ক্ষতি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে কিন্তু আমাদের হাতে শিক্ষায় কতটুকু ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক তথ্য, উপাত্ত তেমন নেই৷ কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষায় জরুরী ভাবে এই তথ্য,উপাত্ত সংগ্রহ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, করোনাকালে বিশ্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি জরিপ বা অনুসন্ধান চালিয়েছে। তারা তুলে আনার চেষ্টা করেছে কোন অঞ্চলে বা এলাকায় শিক্ষার্থীরা কেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কতটুকু ক্ষতিপূরণ যোগ্য এবং তারা সেই অনুপাতে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
শিক্ষাবিদ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদেত প্রকৃত অবস্থা জানতে আগে সঠিক তথ্য, উপাত্ত বের করতে হবে। আমাদের বাস্তবসম্মত প্রকল্প হাতে নিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এভাবেই সংকট মোকাবিলায় কাজ করছে৷ আমরা সেগুলো সরাসরি অনুসরণ করবো না তবে আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে আমাদের দেশের আলোকে শিক্ষায় অগ্রগতি ফিরিয়ে আনতে সমাধানের সূত্র বের করে তা কাজে লাগাতে হবে৷