পরীমনিকাণ্ডে সিটি ব্যাংকের এমডির স্ট্যাটাসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

পরীমনি ও মাসরুর আরেফিন
পরীমনি ও মাসরুর আরেফিন  © সংগৃহীত

ঢালিউড নায়িকা পরীমনিকে জড়িয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিন। রবিবার (৮ আগস্ট) দিবাগত মধ্যরাতে ফেসবুকে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। তাতে তাকে জড়িয়ে প্রকাশিত সংবাদকে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন মাসরুর আরেফিন।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে মাসরুর আরেফিন বলেন, তিনি পরীমনিকে চিনতেন না। ‘বোট ক্লাব’ ঘটনার আগে তার নামও শুনেননি এবং তার সঙ্গে কখনো কথাও হয়নি।

পরীমনিকাণ্ডে সিটি ব্যাংকের এমডির এমন বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও হচ্ছে।

মহিউদ্দিন মোহাম্মদ নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, মাসরুর আরেফিন আপনি পরিমণিকে গাড়ি কিনে দিয়েছেন, ইত্তেফাকের এমন অভিযোগের বিপরীতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমার ভালো লাগেনি।

আপনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘বোট ক্লাব‘ ঘটনার আগে পর্যন্ত পরীমনি নামটাও শুনিনি। আমার তখন মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিল যে, কে এই পরীমনি?

আরেক জায়গায় লিখেছেন, তারা বুঝলেন না যে, ‘আগস্ট আবছায়া’ (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ওপরে চার বছরের গবেষণার শেষে লেখা আমাদের অন্যতম এক প্রধান উপন্যাস), ‘আলথুসার‘ বা ‘আন্ডারগ্রাউন্ড‘ নামের উপন্যাসের লেখকের, বাংলায় ‘ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র‘ কিম্বা ‘হোমারের ইলিয়াড‘-এর এই অনুবাদকের এক পয়সা দুর্নীতির টাকাও থাকতে পারে না যা দিয়ে তিনি নিজের জন্য—ব্যাংক লোন নেওয়া ব্যতিরেকে—একটা বিলাসী বা ভাল গাড়ি কিনতে পারেন। অন্যকে কিনে দেবার কথা বাদই দিন। আমি মনে করি এ দুটি কথাই অত্যন্ত আপত্তিকর।

প্রিজামশন অব ইনোসেন্স, যেটিকে আমরা ইনোসেন্ট আনটিল প্রোভেন গিল্টি বলি, সেটি আইনের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ডকট্রিন। এ ডক্ট্রিন একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে, চূড়ান্ত বিচারিক রায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সুরক্ষা দিয়ে থাকে।

প্রশ্ন হলো, এ ডক্ট্রিন আপনাকে সুরক্ষা দেয় কি না?

আমি বলবো, এ ডক্ট্রিন আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্যই নয়। কাউকে গাড়ি কিনে দেয়া কি অপরাধ? শুধু পরীমনি কেন, একজন স্বীকৃত পতিতাকেও আপনার গাড়ি কিনে দেয়ার অধিকার রয়েছে। আপনি ভালোবেসে কাকে কী দেবেন, সেটি একান্তই আপনার ব্যাপার। এখানে রাষ্ট্র বা মিডিয়া কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

কিন্তু আপনার দাবি, আপনি পরীমনিকে গাড়ি কিনে দেন নি। এমন কি তার নাম পর্যন্ত শুনেন নি। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি পরীমনিকে গাড়ি কিনে দেননি। কিন্তু বোট ক্লাবের ঘটনার আগ পর্যন্ত আপনি পরীমণির নাম পর্যন্ত শুনেননি, এটি আমাকে অবাক করেছে।

বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিকগুলোতে নিয়মিত পরীমনির ছবি ও নাম ছাপা হয়। ঢাকার এমন কোনো রাস্তা নেই, যেখানে পরীমনির পোস্টার কখনো লাগানো হয়নি। ফেসবুক নিউজফিডে পরীমনির হাজার হাজার ছবি ও ভিডিও রয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে আমি যদি প্রোব্যাবিলিটির পারমুটেশোন-কম্বিনেশন করি, তাহলে আপনি পরীমনির নাম কখনো শুনেননি, এ সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি হবে।

এ সম্ভাবনাটি আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, পুরো বক্তব্যে অন্তত একটি কথা আপনি মিথ্যে বলেছেন। যে ব্যক্তি সচেতনভাবে একটি মিথ্যে কথা বলতে পারে, সে ব্যক্তি চাইলে আরও অনেক মিথ্যে কথা বলতে পারে।

আপনি যেভাবে পরীমনির নামকে ডিনাই করেছেন, তার একটি বঙ্গদেশীয় প্যাটার্ন আছে। সাধারণত বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীরা, ইনফাইডালিটিতে হাতেনাতে ধরা খেলে এভাবে নাম অস্বীকার করে।

পরীমনির নাম কখনো শুনেননি, এ বাক্যটি বাদ দিয়ে বক্তব্য দিলে ভালো হতো। এ বাক্যটি এখানে হাইডেন সিগন্যাচারের ভূমিকা পালন করছে।

দ্বিতীয়ত, এখন আমাদের দেশে কেউ বিপদে পড়লেই বঙ্গবন্ধুর আশ্রয় নিয়ে থাকে। আপনিও নিলেন। এ ব্যাপারগুলো মানুষের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করে। আপনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেছেন ভালো কথা (যদিও আমি জানি না কী মানের গবেষণা করেছেন), কিন্তু এরকম দিনের জন্য এটিকে ব্যবহার করবেন, আমি তা আশা করিনি।

কাফকার গল্প, আর হোমারের ইলিয়াড, বাংলায় আরও অনেকেই অনুবাদ করেছেন। আপনি করে থাকলে, এবং আপনার অনুবাদের মান তাদের চেয়ে ভালো হয়ে থাকলে, আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আপনি ইলিয়াড অনুবাদ করেছেন বলে, বা কোনও উপন্যাস লিখেছেন বলে, আপনি কাউকে গাড়ি কিনে দিতে পারবেন না, এমন দাবি ফালতু। বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকের এমডির আয় কম নয়। আমি বিস্তারিত বলতে চাই না।

আমি আমার ‘মানুষ এবং অন্ধকারের প্রশংসা’ রচনাটিতে মানুষের গোপন জীবন নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ওই গোপন জীবনে মানুষ অনেক কিছু করে থাকে, যা সোশ্যাল মোরালিটিতে অফেন্সিভ মনে হলেও কোনো ক্রিমিনাল অফেন্স নয়। আর ইত্তেফাক যে-অভিযোগ তুলেছে, তাকে কিছু লিমিটেড ডোমেইন ছাড়া, আমি সোশ্যাল মোরালিটিতেও অফেন্সিভ বলতে নারাজ। আমি মনে করি, এ বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য দেয়ারও প্রয়োজন ছিলো না। দিলেও, তা এমনভাবে দেয়ার প্রয়োজন ছিলো না।

বার্ডেন অব প্রুফ কখনো অভিযুক্তের উপর বর্তায় না। এটি বর্তায় তার ওপর, যিনি অভিযোগ তুলেছেন। ইত্তেফাক যদি অভিযোগ তুলে থাকে, তাহলে এখন ইত্তেফাকেরই উচিত সে অভিযোগের সমর্থনে এভিডেন্স পেশ করা। ইত্তেফাকের অভিযোগ সত্য না মিথ্যা, এটি প্রমাণ করা আপনার দায়িত্ব নয়। মানুষেরও উচিত নয়, ইত্তেফাকের রিপোর্ট দেখে আপনাকে বিচার করা। এ কথা সব অভিযুক্তের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

আরেকটি কথা না বললেই নয়। আপনার স্ট্যাটাসের শব্দ বা বাক্যবিন্যাস দেখে মনে হয় নি যে আপনি ভালো মানের কোনো লেখক। আমার অনুমান ভুলও হতে পারে।

আওলাদ হোসেন মামুন নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে মানুষ দুটি ভুল কাজ করে— মিথ্যা তথ্য দেয় ও প্রচুর আবেগের অবতারণা করে।

মাসরুর আরেফিনের ফেসবুক আত্মপক্ষ সমর্থনে একটা মিথ্যা হলো পরীমনির নাম না শোনার দাবি।

বাংলাদেশে পরীমনিকে কোনো চটি পত্রিকা ফেরি করেনি। প্রথম আলোর মতো স্বনামধন্য পত্রিকা পরিমনিকে সবচেয়ে বেশি কাভারেজ দিয়েছে। মাসরুর সাহেবের চলাফেরাও একই সমতলে।

পরিমনির সঙ্গে সম্পর্ক ও ঝামেলা কোনো আলু পটল বিক্রেতার নয়, বরং মাসরুর আরেফীনের সম ও উচ্চ পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গেই ছিল। ফলে মাসরুর সাহেব যে পরীমনির নাম না শোনার কথা বলছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এরমধ্যে একটা পিছনের ঘটনা বলি- আগস্ট মাসে মুজিবকে হত্যার ঘটনায় কতজনইতো শোকের নাটকীয়তা করেন, এরমধ্যে সবচেয়ে হার্ডকোর ছিলেন চট্টগ্রামের এক বয়স্ক লোক। সে শিয়াদের মতো হায় মুজিব হায় মুজিব করে পিঠে ছুরি চালিয়েছিল। পরে দেখা গেল ওই লোক প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে এক লোককে মেরে ফেলেছে। তার ওই হত্যাকাণ্ডটি দেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংসতা।

এখন কথা হলো মাসরুর সাহেব নিজেকে নির্দোষ দাবি করতে গিয়ে আবেগঘন নাটকীয়তা করতে আগস্টে মুজিবকে হত্যা নিয়ে লেখা উপন্যাসের কথা বললেন। বাংলাদেশের ইতিহাস বিচার করলে কারোই মনে হবে না যে এরকমম উপন্যাস লেখিয়েরা নিরীহ হয়। বরং মুজিবভক্ত শিশু সাহিত্যিককেও আমরা ক্রিমিনাল হতে দেখে আসছি।

পরিহাস হলো, মাসরুর সাহেব আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তার লেখক পরিচয়টা সামনে এনে বলছেন এমন লোক দুর্নীতি করতে পারে না। কিন্তু তিনি যে ব্যাংকার তা উহ্য রাখলেন সেখানে!

উল্লেখ্য ২০১৯ সালে যৌন হয়রানির অভিযোগে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিনসহ তিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। রাজধানীর গুলশান থানায় সেসময় মামলাটি দায়ের করেন সিটি ব্যাংকের সাবেক সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরা সুলতানা পপি।

নিচে মাসরুর আরেফিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দেওয়া হলো- 

 


সর্বশেষ সংবাদ