নিউইয়র্কে যেভাবে আয়োজিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’
রবি শঙ্করের নিজের কথা ছিল এমন: খবরগুলো পড়ে আমার খুব মন খারাপ ছিল, আর আমি বললাম, জর্জ, এই হলো অবস্থা, আমি জানি এটা তোমার দুর্ভাবনার বিষয় না, তুমি সম্ভবত এটা বুঝে উঠতেও পারবে না। কিন্তু আমি যখন জর্জের সঙ্গে কথা বললাম, তিনি বেশ আবেগ তাড়িত হয়ে ওঠেন... আর আমাকে বলেন, ‘‘হ্যা,আমার মনে হয় আমি হয়তো কিছু একটা করতে পারবো।’’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তহবিল সংগ্রহে নিউইয়র্কে যে গানের আয়োজন হয়েছিল, বিখ্যাত সেই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের পটভূমি সম্পর্কে এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের পহেলা অগাস্টের সেই আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন পপ সঙ্গীতের তৎকালীন সুপারস্টার বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন এবং এরিক ক্ল্যাপটনের মত তারকারা।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে, কিন্তু জীবন বাঁচাতে এরই মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত আশ্রয় নিতে হয়েছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তখন খাবারের সংকট, আর কলেরার মতো রোগে মানুষ আরেক সঙ্গীন পরিস্থিতির মুখোমুখি।
রবি শঙ্কর
আর সেই পরিস্থিতিই ব্যথিত করে বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শঙ্করকে। তার চিন্তার ফসল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ সেই কঠিন পরিস্থিতিতে তহবিল জোগাড়ের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
মূলত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টার পাশাপাশি বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন জানানো অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তার জন্য উদ্যোগটি নিয়েছিলেন রবি শঙ্কর।
তিনিই প্রথম কথা বলেন পপ সঙ্গীতের সুপরিচিত ব্যান্ড বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে, এবং তিনি সম্মত হওয়ার পরে নিজেই যোগাযোগ করেন আরও শিল্পীদের সাথে। এরপর রচিত হয়েছে একটি ইতিহাস- ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এমন একটি আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন, যে ধরণের আয়োজন এর আগে বিশ্বের মানুষ কখনও দেখেনি।
আর জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানের মতো তারকাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অন্যরকম এক পরিচিতি পায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে। ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগানো বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। কিন্তু ১৯৭০ সালে বিটলস ভেঙ্গে যাওয়ার পর ব্যান্ডের সদস্যরা আলাদা করে নিজস্ব গানের কাজ শুরু করেন।
তখন জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকে জর্জ হ্যারিসনের, এবং তার ‘অল থিংস মাস্ট পাস’ অ্যালবাম ব্যাপক সাফল্য পায় ও হ্যারিসনকে নিয়ে উন্মাদনা তৈরি হয়। ষাটের দশকেই রবি শঙ্করের সাথ পরিচয় হয়েছিল হ্যারিসনের। জন লেনন, রিঙ্গো স্টার, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন এবং বিখ্যাত সব পপ শিল্পী
ততদিনে বিটলস ভেঙ্গে গেলেও জন লেননের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। তিনি রাজী হলেন কনসার্টে অংশ নিতে। তবে পল ম্যাককার্টনি সোজা ‘না’ বলে দিলেন। আর রিঙ্গো স্টার জানালেন তিনি আছেন।
ম্যাককার্টনির না-এর ব্যাপারটা এক প্রাক-কনসার্ট সংবাদ সম্মেলনে বেশ স্বাভাবিক স্বরেই জানিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন।
বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেলের মতো তারকারা ছিলেন। ছিলেন ভারতীয় সরোদ বাদক আলী আকবর খান ও তবলা বাদক আল্লা রাখার মতো ভারতীয় সঙ্গীতের সুপরিচিত উস্তাদরাও।
জুলাইয়ের শুরুতেই একটি ছোটো বিজ্ঞাপন ছাপা হয় নিউইয়র্ক টাইমসের পেছন পাতায় - ‘হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ দুটো কনসার্ট আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য।
বিটলসদের সম্ভাব্য রি-ইউনিয়নের আঁচ পেয়েই হোক, তারকাদের নাম দেখেই হোক, কিংবা বহুদিন পর কনসার্ট হচ্ছে এই খুশীতেই হোক - মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যেই দুটো কনসার্টের ৪০ হাজার টিকেট বিক্রি শেষ হয়ে যায়।
এমনিতে সাংবাদিকরা ফ্রি টিকেট পেয়ে থাকেন, তবে তারাও এই উদ্যোগের নেপথ্য কারণ জেনে ১২ হাজার ডলার অনুদান দিলেন আয়োজকদের।
তবে জন লেনন শেষ পর্যন্ত কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অংশ নেননি। তার স্ত্রী এবং গানের সঙ্গী ইয়োকো ওনোর সঙ্গে তার বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়,আর কনসার্টের কয়েকদিন আগেই তিনি নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে হ্যারিসনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো যে দুনিয়াতে এত সমস্যা থাকতে হঠাৎ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে কেন। তার সোজাসাপ্টা উত্তর ছিলো তার গানের কথাগুলোর মতোই : আমার বন্ধু আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে, আমার মনে হয়েছে আমার তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।
যদিও সংবাদ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা এসেছে, কিন্তু কনসার্টের আয়োজনের কারণ হিসেবে সেই বিষয়টা সচেতনভাবেই এড়াতে চেয়েছেন হ্যারিসন।
যাতে কোন রাজনৈতিক রঙ না লাগে এবং তৎকালীন নিক্সনের মার্কিন প্রশাসন না চটে, সেজন্য বাংলাদেশের দুর্গত শিশুদের ত্রাণের কথা বলেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন কনসার্ট থেকে পাওয়া সব অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থী শিশুদের সাহায্যে পাঠানো হবে।
এমনকি কনসার্টের পোস্টারেও ব্যবহৃত হয়েছে একটি শিশুর ছবি, রেকর্ড লেবেলেও। আর এ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি।
ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাদির জুনাইদ তার একটি লেখায় লিখেছেন যে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বেনিফিট কনসার্ট।
তিনি লিখেন, সমস্যা পীড়িত মানুষের সাহায্য করার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কনসার্টের আয়োজন করা পরবর্তী সময়ে নিয়মিত একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের প্রথম বেনেফিট কনসার্টটি আয়োজিত হয়েছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেয়া দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। এবং এই কনসার্টটির অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পুরো বিশ্বে একটি সচেতনতা সৃষ্টি করা।
তিনি লিখেছেন, চল্লিশ হাজার দর্শকের সামনে সেই কনসার্টে একই মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী। এর আগে কখনো কোনও কনসার্টে এক সঙ্গে এত তারকা সঙ্গীতশিল্পী অংশগ্রহণ করেননি। ফলে এই কনসার্টকে ঘিরে সেই সময় পশ্চিমা বিশ্বে এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের মধ্যে তৈরি হয় তুমুল আগ্রহ।
‘‘কনসার্টের টিকেট বিক্রি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই টিকেট কেনার জন্য দর্শকদের ভিড় শুরু হয়ে যায়, একটি ভালো সিটের জন্য দর্শকরা ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের সামনে কয়েকদিন আগে থেকেই অপেক্ষা করতে শুরু করেন’’।
তিনি আরও লিখেন: কনসার্টের আগের দিন রাতের বেলা দেখা যায় শুয়ে বসে আছে তরুণ-তরুণীরা এবং সবাই উন্মুখ এই কনসার্ট দেখার জন্য। পরদিন যখন খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পীরা একের পর এক পরিবেশন করতে থাকেন বিখ্যাত সব গান, দর্শকরা আনন্দে বিমোহিত হয়ে উঠেন।
‘‘যে বাংলাদেশ নামটি পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করে তোলার আগ্রহ দেখা যায়নি, এই কনসার্টের কারণে সেই বাংলাদেশ নামটিই একদিনে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই কনসার্ট তাই কেবল একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানই ছিলো না, তা হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী এক প্রতিবাদ’’।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ভারতীয় শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। পরিবেশিত হয় বাংলা লোকসঙ্গীতের অনন্য সুর - বাংলা ধুন। আর কনসার্টের শেষ গানটি ছিলো জর্জ হ্যারিসনের লেখা- ‘বাংলাদেশ’।
স্কুলের পাঠ্য
রবি শঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউইয়র্কের এ কনসার্টের তথ্য আছে বাংলাদেশে এখনকার স্কুলের পাঠ্যবইয়েও।
অষ্টম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ে লেখা হয়েছে: ‘‘নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী জর্জ হ্যারিসন ‘বাংলাদেশ কনসার্ট’ আয়োজন করে তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ মুজিবনগর সরকারের কাছে তুলে দেন। ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী রবি শঙ্কর মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে উজ্জীবিত করেন। তিনি বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম’’।
আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক লেখা প্রকাশিত হয় জন্মযুদ্ধ ৭১ নাম একটি পোর্টালে। সেখানে দ্যা কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: কিছু অজানা অধ্যায় শীর্ষক একটি লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে কনসার্টের ধারণাটির জন্ম সম্পর্কে অনেকরকম বক্তব্য আছে।
এতে বলা হয়: ৭০ সালে ভোলায় প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনটির পরপরই বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের জন্য কিছু করার কথা ভাবছিলেন রবি শঙ্কর। ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন তার ছাত্র ও বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। হ্যারিসন অনেকদিন ধরেই ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত, সুবাদেই সেতার শিখছিলেন শঙ্করের কাছে।
‘‘এরপর বিটলসের নিজস্ব কোম্পানি অ্যাপেল রেকর্ডসে রবি শঙ্কর রেকর্ড করেন 'জয় বাংলা' আর হ্যারিসন তার 'বাংলাদেশ'। উদ্দেশ্য গানের বিক্রি ও রয়ালটি বাবদ টাকা বন্যাদুর্গতদের জন্য ব্যয়। এই উদ্দেশ্যটা নেওয়া হয়েছিলো রেকর্ডিং শুরুর আগেই। ততদিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশে’’।
এতে আরও বলা হয়, এবার অনুরোধে পরিবর্তন আনলেন শঙ্কর। হ্যারিসনকে বললেন ছোটোখাটো একটা কনসার্ট আয়োজনের। উদ্দেশ্য ২৫-৩০ হাজার ডলার সংগ্রহ করে শরণার্থীদের সাহায্য করা। হ্যারিসন প্রস্তাবটা লুফে নিলেন, তবে তার মাথায় এলো অন্য চিন্তা। বিটলসের একজন সদস্য হিসেবে নিজের তারকামান ও বাজারদর চিন্তা করে এই আত্মবিশ্বাস জন্মালো যে কমপক্ষে এক মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা খুবই সম্ভব।
‘‘জুনের শুরুতে প্রস্তাবটি নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করলেন হ্যারিসন। ফোন করতে লাগলেন গায়ক-বাদক বন্ধুবান্ধবকে। ভেন্যু ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন খালি পাওয়া গেলো ১লা অগাস্ট, আগে বা পরের সব তারিখ বুকড’’।
জর্জ হ্যারিসন আর বাংলাদেশ
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন ঢাকায় এসেছিলেন। অলিভিয়া 'জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফের' অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ দেখতেই এসেছিলেন তিনি। ওই সফরের সময় অলিভিয়া হ্যারিসনের সঙ্গে সাক্ষাত করেন দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
‘‘অলিভিয়ার কাছে শুনেছিলাম যে কনসার্টটি করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা তাঁর অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল’’ ২০১৬ সালের ১২ইডিসেম্বর প্রথম আলোতে লিখেছিলেন মতিউর রহমান।
তিনি আরও লিখেন: অলিভিয়া আমাকে বলেছিলেন, 'জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবি শঙ্করকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিলেন তিনি। অন্যদিকে জর্জ নিজের রেকর্ডিং নিয়েও ব্যস্ত ছিল। সত্তরে বিটলস ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে জীবন গড়তে সে মনোযোগী ছিল।
‘‘সেই সময়েই রবি শঙ্কর বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চান। এই উদ্যোগে জর্জকে পাশে পেতে চান তিনি। জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার নিযুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে’’।
অলিভিয়ার বরাত দিয়ে মতিউর রহমান আরও লিখেন, তারপর থেকেই জর্জ কনসার্টের জন্য বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল ও অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বব ডিলান আর এরিক ক্ল্যাপটন অনুষ্ঠানের একদিন আগে নিউইয়র্কে এসে উপস্থিত হন। আর 'ইমাজিন' গানের অমর শিল্পী জন লেনন অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে তাঁর অপারগতার কথা জানান জর্জকে।
এভাবেই রবি শঙ্করের উদ্যোগে আর জর্জ হ্যারিসনের প্রচেষ্টায় রচিত হলো একটি ইতিহাস - তখনও জর্জ হ্যারিসনের কাছে অচেনা এক দেশের মানুষের জন্য সেই ইতিহাস রচনা করলেন বিশ্বখ্যাত এই শিল্পীরা।
এই কনসার্ট থেকে সংগৃহীত আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলার শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করা হয়েছিলো। কিছু অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে, যেটি তখন মুক্তিকামী বাংলাদেশীদের অঘোষিত মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিলো।
আই, মি, মাইন
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ কিভাবে আয়োজিত হয়েছিল, তা উঠে এসেছিল জর্জ হ্যারিসনের একটি বইতেও। ‘আই, মি, মাইন’ তার আত্মজীবনীমূলক বই এবং সে বইতেও যথারীতি উঠে এসেছে জর্জ হ্যারিসন কিভাবে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন।
মতিউর রহমান লিখেছেন, তিনি (হ্যারিসন) ১৯৭১ সালের জুন মাসে তাঁর রাগা অ্যালবামের জন্য লস অ্যাঞ্জেলসে কাজ করেছিলেন। সে সময় রবি শঙ্কর বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য একটা কনসার্ট করতে চান বলে জর্জকে জানান। তারপর রবিশঙ্কর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত নানা দেশের পত্রিকা ও সাময়িকীর সংবাদগুলো পাঠান জর্জের কাছে।
‘‘জর্জ লিখেছেন, ‘বিষয়টি কী, আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলাম। আমার মনে হলো, কাজটার ব্যাপারে আমার বোধ হয় তাকে সাহায্য করা উচিত।’ তিনি লিখেছেন, এভাবেই জড়িয়ে গেলাম। পরে যা কনসার্ট ফর বাংলাদেশ হয়ে ওঠে’’।
হ্যারিসনতে উদ্ধৃত করে মতিউর রহমান আরও লিখেছেন, সত্যি বলতে কি, সবার উপস্থিতিতে একটা মহড়া আমরা করতে পারিনি। নানা অসুবিধার মধ্যে অগোছালোভাবে কাজটা করলাম আমরা।...তারপর কনসার্ট করলাম আমরা। দুটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। প্রথম অনুষ্ঠানের সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় কনসার্টটি করেছিলাম। কপালই বলতে হবে, সবকিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়েছিল।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পর এ ধরনের আয়োজন আরও হয়েছে। ১৯৮৫ সালে হয়েছিল লাইভ এইড- উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকার মানুষদের সাহায্য করা। আর কনসার্ট ফর নিউইয়র্ক সিটি হয়েছিল ২০০১ সালে নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলার পর।
বাংলাদেশ নিয়ে কনসার্ট আয়োজনের পর সাক্ষাতকারে হ্যারিসন বলেছিলেন, কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিলো একটি নৈতিক পদক্ষেপ। আমরা দেখিয়েছি যে রাজনীতিকদের চেয়ে শিল্পীরা ও সাধারণ মানুষ বেশি মানবিক। মানুষ রক শিল্পীদের চ্যারিটির জন্য পারফর্ম করাকে গ্রহণ করেছে। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]