২৯ জুলাই ২০২১, ১৪:৪৮

বিষাদের এই ছুটি আর চায় না শিক্ষার্থীরা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ছুটি  © ফাইল ছবি

এক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের খবর শিক্ষার্থীদের কাছে আনন্দের হলেও করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটি যেন এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অনলাইন ক্লাস চালু থাকলেও তাতে মিলছে না আশানুরূপ সাফল্য। মাঝে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা প্রসঙ্গে ব্যপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে দৈনিক করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে নারাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এদিকে দীর্ঘদিন বন্ধে বর্তমান শিক্ষাকে ঘিরে অনিশ্চয়তা কাটছে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ, হতাশা ও দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে। মানসিক চাপে কোন কোন শিক্ষার্থী আবার আত্নঘাতী হয়ে উঠছে।

তথ্যানুযায়ী, দেশে একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিন আজ বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই)। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিনে এসেও অনিশ্চয়তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত। দফায় দফায় লকডাউন ও করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির ফলে শিক্ষাখাত এখন চরম হুমকির মুখে। অন্যদিকে একঘেয়ে জীবন থেকে বাঁচতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে মরিয়া শিক্ষার্থীরা।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী তারেক রবিন বলেন, দীর্ঘ ছুটির ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের মূল লক্ষ্য থেকেই ছিটকে পড়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে শিক্ষার্থীদের ভেতর পড়াশোনার যে চাপ থাকতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে নেই তেমন কোনো চাপ। অনিশ্চয়তায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে গেমস, স্মার্টফোন আসক্তি সহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে৷এছাড়া অনার্সে সেশন জটের কবলে পরা অনেক শিক্ষার্থী হতাশায় মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায়। শুরু থেকেই সুষ্ঠ পরিকল্পনা গ্রহণ করলে হয়তো এতদিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হতো না। খুবই দুঃখের ব্যাপার যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০ দিন পূর্ণ হলেও কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তা এখনও অনিশ্চয়তা কাটছে না।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ুয়া শিক্ষার্থী আরাফাত হোসাইন বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। অনলাইনে শিক্ষাব্যবস্থা চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে নেটওয়ার্ক সমস্যা। গ্রামের শিক্ষার্থীরা নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এছাড়া ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ফলপ্রসু হচ্ছে না। এমতাবস্থায় আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।কোভিড পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ ইসফাকুল কবির আসিফ বলেন,করোনাকালীন শিক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ফলপ্রসূ সমাধান দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই দোদুল্যমান অবস্থা শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে দূর্বল করে তুলছে।স্কুল পর্যায়ে সমস্যাটি আরো ভয়াবহ। অন্যান্য প্রসঙ্গের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি শিক্ষার আলোচনা। শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহ ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। শিক্ষায় অগ্রগতি ফিরিয়ে আনতে দ্রুত শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদানে গুরুত্ব ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা প্রসঙ্গে নীতিনির্ধারকদের গভীরভাবে ভাবতে হবে৷

চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা নুসরাত ইয়াসমিন ইমু বলেন, দীর্ঘ ছুটি এখন একঘেয়েমিতে পরিনত হয়েছে। পড়াশোনার গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থীই পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিনে এসেও এখনো আমরা জানিনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলবে। সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। তা না হলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা থেকে আরও দূরে সরে যাবে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো. সোহেল বলেন, বিংশ শতাব্দী থেকে মানুষ যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন করে চলেছে তার সিংহভাগই একটা ক্ষুদ্র শ্রেণির মধ্যেই আবদ্ধ। বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলই থেকে গেছে এই উৎকর্ষতার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের দেশও সেই অধিকাংশ অঞ্চলের অংশীদার। আমরা যতই ডিজিটাল ডিজিটাল বলে মুখে ফেনা তুলি না কেন, আমাদেরকে বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে। করোনাকালে আমরা দুটি বাজেট পেলেও পাইনি পরিকল্পিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্য বান্ধব বাজেট। কর্তৃপক্ষ বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কতটুকু ভাবছে সে ব্যপারে আমরা সন্দিহান। করোনার সংকট কখন দূর হবে তা বলা কঠিন তাই এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, জাতিকে এই সংকটের ভয়াবহতা থেকে অনেকাংশেই বাচানো সম্ভব। শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনলাইনভিত্তিক ঢেলে সাজাতে হবে, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এই সব সমস্যার সমাধান সরকারের একরা পক্ষে সম্ভব না।সরকারের উচিত হবে সকলকে সাথে নিয়ে উপযুক্ত সমাধানে পৌঁছানো।

সম্প্রতি তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা জরিপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে সৃষ্ট সমস্যার ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে ৬১.২ শতাংশ তরুণ-তরুণী বিষণ্ণতায় ভুগছেন। এছাড়া ২১ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণের ভাবনায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। শুধু তাই নয়, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, আর্থিক সমস্যা, সেশনজট, অনশ্চিত ভবিষ্যত, মোবাইল ইন্টারনেটের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিসহ নানান সমস্যা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডা. আনোয়ারা আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা মানেই শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে একটা অনিশ্চয়তা, হতাশা ও মানসিক সমস্যায় ভুগবে যা এখন স্পষ্ট প্রতীয়মান। যেহেতু আমরা এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারিনি সেহেতু শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ হতে পারে আশার আলো। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও জটিলতার শেষ নেই। এখনো শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

ডা. আনোয়ার আলম বলেন, টিকা প্রদান কর্মসূচি শুধু হাসপাতালে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবেনা,এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগাতে হবে৷ জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে একেকটা সেন্টার করে টিকাদান কর্মসূচির কার্যক্রমকে আরো সহজভাবে সম্প্রসারণ করতে হবে। এছাড়া সরকার কর্তৃক সহনীয় পর্যায়ে টিকার মূল্য নির্ধারণ করে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকা দিলে দ্রুত তৃণমূল পর্যায়ও টিকার আওতায় চলে আসবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একটা বিরাট অংশ টিকার আওতায় এলে ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার একটা জোর সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তা নাহলে এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দিন আরও দীর্ঘ হলে একটি প্রজন্ম বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

উল্লেখ্য, গত বছর ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।