ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের আহবান অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের
অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বন্ধের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মান ও মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন অথবা বাতিলের আহবান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
আজ সোমবার (২৬ জুলাই) ‘ভিন্নমতের স্থান নেই’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটির এই আহবান এসেছে।
বাংলাদেশের ১০ জন নাগরিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা পর্যালোচনা করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল ‘ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সমালোচনা’ করার কারণে তাদের ‘বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতনের মত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার’ হতে হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তত ৪৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাদের বেশিরভাগকেই অনলাইনে ভুয়া ও আক্রমাণাত্মক বক্তব্য প্রকাশের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় বলে এ মানবাধিকার সংগঠনের ভাষ্য।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেপ্তারদের মধ্যে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, গায়ক, অধিকারকর্মী, উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী, এমনকি একজন কৃষকও রয়েছেন, যিনি লিখতে বা পড়তে জানেন না।
এর মধ্যে একটি মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদ ১০ মাস কারাগারে থেকে সেখানেই মারা গেছেন। কারাগারে তিনি ‘নির্যাতনের শিকার’ হয়েছিলেন বলে কারাবন্দি একজনের বরাতে অভিযোগ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
এ সংগঠনের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের ক্যাম্পেইনার সাদ হামাদি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় কর্তৃপক্ষ যে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতেই স্পষ্ট, বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করা বা ভিন্নমত প্রকাশ করা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
“মতপ্রকাশে এমন অন্যায্য বিধিনিষেধ বাংলাদেশের সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সুশীল সমাজের কাজের পরিসর সঙ্কুচিত করেছে।”
শুধুমাত্র মতপ্রকাশের অধিকারের চর্চা করায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মুক্তি দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন সাদ হামাদি।
২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনলাইনে কোনো মন্তব্য শেয়ার করার কারণেও বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করা এবং গ্রেপ্তারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এ বিষয়গুলো ইন্টারন্যাশনাল কভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসে (আইসিসিপিআর) বর্ণিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ‘লঙ্ঘন’, যে সনদে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে।
সাদ হামাদি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল আইনকে আইসিসিপিআর এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পদক্ষেপ নিতে ২০১৮ সালের মে মাসে ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ চলাকালে জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশের যেসব সুপারিশ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছিল, সেগুলোর কথা আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার আগেই জাতিসংঘের বিশেষ দূতরা এর খসড়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র সে সময় বাংলাদেশ সরকারকে ওই আইন সংশোধনেরও আহ্বান জানিয়েছিল।
“এসব সুপারিশ গ্রহণ করার পরও সরকার এখন পর্যন্ত সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে।”
যাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে পর্যালোচনা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মুশতাক আহমেদ ছাড়াও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রুহুল আমিন, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের কৃষক আবু জামান, বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ান, আলোকচিত্র সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, ব্যবসায়ী এমদাদুল হক মিলন, সুনামগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক মাহতাব উদ্দিন তালুকদার এবং চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা দলের নেতা দেওয়ান মাহমুদা আক্তার লিটার কথা এসেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ডিজিটাল নিরপাত্তা আইনে মানহানির অপরাধকে যেভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাতে ‘মারাত্মক ত্রুটি’ রয়েছে। এর মাধ্যমে আইনটিকে ‘ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে’ পরিণত করা হয়েছে।
মানহানির অভিযোগকে ফৌজদারি আইনের বদলে দেওয়ানি আইনে বিচারের জন্যও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।