কেজি প্রতি সাড়ে ৫ টাকার তরমুজ ঢাকায় ৫০ টাকা
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তরমুজ ফলান কৃষক আর লাভের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। আর এ কারণেই বাড়তি দামে কিনে খেতে হচ্ছে ভোক্তাদের। স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে কথা বলে এবং বাজারে ঘুরে জানা যায়, কৃষকদের কাছ থেকে ফড়িয়ারা ‘খেত মূলে’ তরমুজ কিনে পাইকারি মোকামে এনে এক ধাপ লাভে বিক্রি করেন। আবার পাইকারি মোকাম থেকে আরেক ধাপ লাভে ‘শ মূলে’ খুচরা ব্যবসায়ীরা কেনেন। এরপর খুচরা ব্যবসায়ীরা আবার ভোক্তা পর্যায়ে তা কেজি দরে আরেক দফা লাভে বিক্রি করেন। ফলে তিন হাত ঘুরে এই তরমুজের দাম এলাকাভেদে ১০ গুণও বেড়ে যায়।
মাঠ পর্যায়ে কেজি প্রতি সাড়ে ৪ টাকা থেকে সাড়ে ৫ টাকা করে তরমুজ বিক্রি হলেও তা ঢাকায় এসে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। যার ফলে মাঝারি সাইজের একটি তরমুজের দাম পরে যায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রেতারা।
বরগুনার আতমলী উপজেলার পশ্চিম সোনাখালী গ্রামের চাষি মাহবুব মাতুব্বর এবার ১২ একর জমিতে তরমুজ আবাদ করেন। এতে তার তিন লাখ টাকা খরচ হয়। এবার প্রতি একর ১ লাখ টাকা করে ১২ একর জমির তরমুজ বিক্রি করেছেন ১২ লাখ টাকায়। কেজি দরে হিসাব করলে তাতে প্রতি কেজি তরমুজ তিনি পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন ৫ টাকা ৫৫ পয়সায়। সেই মাহবুবের খেতের সাড়ে পাঁচ টাকা কেজির তরমুজই হয়তো ঢাকায় কেউ ৫০ টাকা কেজি দরে কিনে খাচ্ছেন।
এমনি ঘটনা দেখা যায় আমতলীর কুকুয়া ইউনিয়নের চুনাখালী গ্রামের ওহাব মৃধা, বাহাউদ্দিন হাওলাদার ও রাজ্জাক মৃধা যৌথভাবে ৩৬ একর জমিতে তরমুজ খেতে। খেত থেকে ৩১ লাখ টাকায় সব তরমুজ বিক্রি করেছেন। কেজি দরে হিসাব করলে তাতে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি করেছেন ৪ টাকা ৭৮ পয়সায়।
সড়কপথে খুলনা থেকে আনা তরমুজ ট্রাক থেকে বাদামতলী ফলের আড়তে নিচ্ছেন শ্রমিকেরা। তবে সব জায়গায় তরমুজ চাষের খরচ এবং দাম এক রকম নয়। যেমন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নের চর লতা গ্রামের চাষি হামিরুল ফকির এ বছর পাঁচজনের সঙ্গে মিলে ১৮ একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন। আবাদে মোট খরচ হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। খেতে ২২ হাজার পিস তরমুজ হয়েছে। গড়ে প্রতিটি তরমুজ ১২৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তারা। খেতে বসেই তিনি তরমুজ বিক্রি করেছেন ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার।
বরিশাল বিভাগের বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চাষিদের কাছ থেকে তরমুজ কিনে বিক্রি করেন ময়মনসিংহের মোশারফ হোসেন এবং কুমিল্লার দেলোয়ার হোসেন। মঙ্গলবার এই দুই ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, তারা আমতলী থেকে গত সপ্তাহে ৫ হাজার ৫০০ তরমুজ কিনেছেন ৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকায়। কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে তা পাইকারি বিক্রি করেছেন তিন থেকে পাঁচ কেজি ওজনের শ বিক্রি করেছেন ২০ হাজার, ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের (মাঝারি আকারের) তরমুজের শ বিক্রি করেছেন ২৮ হাজারে আর ১০ থেকে ১৮ কেজি ওজনের শ বিক্রি করেছেন ৪৫ হাজার টাকায়। লাভ প্রায় ৫ লাখ টাকা।
কয়েকজন তরমুজ ব্যবসায়ী বলেন, তরমুজ পরিবহনে খরচটাও কম নয়। আবার পচনশীল হওয়ায় ঝুঁকিও থেকে যায়। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পটুয়াখালী জেলার বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তরমুজ কিনে তা ট্রাক্টরে ভর্তি করে নদীর পাড়ে এসে ট্রলারে করে গলাচিপার হরিদেবপুর নিয়ে আসতে প্রতিটি তরমুজের ট্রলার ভাড়া ৩ টাকা ও ট্রলার থেকে তুলে ট্রাকে ভর্তি করতে ৫ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া গলাচিপা থেকে প্রতিটি ট্রাক ভাড়া পড়ে ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। তবে লকডাউনের সময় ৩৫ হাজার থেকে ৩৮ হাজার টাকাও গুণতে হয়েছে। এ কারণে তরমুজের দাম বেশি পড়ে যায়। তবে প্রচুর চাহিদা থাকায় বেশি দামেও তরমুজ কিনতে পিছপা হননি ফড়িয়ারা।
খুচরা বাজারে তরমুজের বেশি দামের বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক আফতাব উদ্দীন বলেন, ‘আমি যত দূর খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এবার কৃষকেরাও তরমুজের ভালো দাম পেয়েছেন। মূলত এবার তীব্র গরম, রমজান এবং লকডাউনের মধ্যে পরিবহনের কোনো বাধা না থাকায় বাজার সম্প্রসারণ হওয়ায় তরমুজের চাহিদা বেশি। তাই বাজারে হয়তো দামও কিছুটা বেশি।’
কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে এবার তরমুজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় আবাদ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টরে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দক্ষিণের এই বিভাগে এবার ১২ লাখ টনের বেশি তরমুজ উৎপাদিত হয়েছে। প্রতি কেজি ১০ টাকা মূল্য ধরা হলেও উৎপাদিত এই তরমুজের বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু দক্ষিণের তরমুজকেন্দ্রিক এই বড় অর্থনীতির কম অংশই প্রান্তিক কৃষকের পকেটে যাচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আড়তগুলো বন্ধ। সেখানে কোনো তরমুজ নেই। এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, সোমবার বিকেলে নগরে খুচরা বাজারে ১৪ জন ব্যবসায়ীকে ভ্রাম্যমাণ আদালত অতিরিক্ত দামে তরমুজ বিক্রি করায় জরিমানা করায় এর প্রভাব পড়েছে পfইকারি আড়তে। অনেকেই অভিযানের ভয়ে আড়ত বন্ধ রেখেছেন।