‘পারলে বাসায় এসে পড়ান, না হলে অন্য শিক্ষক দেখব’

টিউশনি
টিউশনি  © সংগৃহিত

‘গতবছর হঠাৎ করেই করোনার প্রকোপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন বাড়িতেই কাটাতে হয়। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবারও ঢাকায় আসি। কিন্তু হঠাৎ করে ঢাকায় এসে নতুন করে থাকা-খাওয়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক চেষ্টা করেও কোন কাজ জোগাড় করতে না পেরে উপায়ান্তর না দেখে টিউশন মিডিয়ায় তিন হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা বেতনের একটি টিউশনি নেই। কিন্তু কপাল এতই মন্দ একমাস না ঘুরতেই আবারও করোনার সংক্রমণে সব বন্ধ হয়ে গেলো। এখন ঢাকায় থেকে যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে থাকা খাওয়ার খরচ জোগাতেই নাভিশ্বাস উঠে যায়। মাঝে আমার পরীক্ষা শুরু হলেও এখন করোনার প্রকোপে আবার বন্ধ। তাই ভেবেছিলাম বাড়িতে চলে যাবো আর টিউশনিটা অনলাইনে করাবো। তাতে কিছুটা সাশ্রয় হবে। কিন্তু আমার ছাত্রের অভিভাবককে এই প্রস্তাব দেয়ার সাথে সাথেই সরাসরি বললেন, ‘বাসায় এসে পড়াতে পারলে পড়াবেন, না হয় আমরা ভিন্ন শিক্ষক দেখব।’ ধার করে টিউশন মিডিয়ায় যে টাকা দিয়েছিলাম সে টাকাই এখনো উঠেনি। তাই টিউশনি ফেলে বাড়িতে চলে যাওয়ার সাহস করতে পারিনি।’

কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী সালেহীন আহমেদ। শুধু তিনিই নয় বরং রাজধানীজুড়ে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে করোনাকালীন এই সময়েও শুধুমাত্র টিউশনি থেকে ছুটি না পাওয়ায় সবকিছু বন্ধ থাকার পরও মেসে বা হোস্টেলেই থাকতে হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি মাথায় নিয়েই ছুটতে হচ্ছে টিউশনি পড়াতে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীর প্রায় ৬০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী নিজেদের খরচ জোগাতে পড়াশোনার পাশাপাশি খন্ডকালীন বিভিন্ন কাজ বেছে নেন। তারমধ্যে বৃহৎ একটি অংশ টিউশনি ও কোচিং এর সাথে জড়িত। এরমধ্যে কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে যারা সামান্য টাকায় নিজের খরচ চালিয়ে নিতেন; গতবছর করোনার বন্ধের প্রথম থেকেই তাদের সেই পথ বন্ধ রয়েছে। যার ফলে এসব শিক্ষার্থীরাও পড়েছেন বিপাকে। তাই বাধ্য হয়েই যে যেখানে পারছেন সেখানেই কাজ করার চেষ্টা করছেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, মফস্বল থেকে রাজধানীতে উচ্চশিক্ষা নিতে আসা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়াশোনা ও জীবন মানের ব্যয় নির্বাহ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার করোনার কারণে মার্কেট, রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড বন্ধ হওয়ায় এসব জায়গায় খন্ডকালীন চাকরির সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়েই একমাত্র টিউশনির উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। সেজন্যই অভিভাবকদের কথার বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই। তাই করোনাকালীন এই সময়ে ব্যয় নির্বাহ করতে জীবনের মায়া কিংবা সংক্রমণের ঝুঁকির চিন্তা না করেই পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল যোগে ছুটছেন টিউশনিতে।

তবে এত কষ্টের পরও রয়েছে ঠিকমতো বেতন না পাওয়ার অভিযোগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নাজিয়া হাসান শাওন নামের এক শিক্ষার্থী লেখেন,‘‘আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়েদের আত্মসম্মানটা অনেক বেশি হয় সবসময়। সাথে কৃতজ্ঞতাবোধটাও। গতবছর অক্টোবর থেকে ক্লাস সেভেনের এক বাচ্চাকে পড়াচ্ছিলাম। সবকিছুই ভালো ছিলো। কিন্তু বেতন দিতো না ঠিকমত। এর মধ্যে আমি নিজেই বললাম আন্টি আমাকে যদি আরো একটা টিউশনির ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে অনেক উপকার হতো। তিনি এবছর জানুয়ারিতে আরেকটা টিউশনি ঠিক করে দিলেন। কিন্তু ওনারও একই সমস্যা। দুই তিন মাস পর গিয়ে এক মাসের বেতন দেন। নতুন টিউশনিটা ঠিক করে দেওয়াতে উনার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই দেড়ি করে টাকা দেওয়াটা মেনে নিচ্ছিলাম। কিন্তু উনি সেটাকেই সুযোগ হিসেবে নিচ্ছিলো। আমারও কষ্ট করে উপার্জন করা সেটাতো উনাকে বুঝতে হবে। হয়তো কয়েক মাস তার সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিমাসে একই কথা। অথচ আমি কখনোই পড়ানো বাদ দেই না। দিলেও কভার করে দেই। স্টুডেন্টকেও অনেক ভালোবাসি। তিনি আমাকে গত তিন মাসের বেতন দেয়নি। গতকাল আমি বাসায় গিয়ে বেতন চাইতে জানিয়ে দিলো সে দুইমাসের বেতন দেবে। তাও এখন না। টাকা পয়সার নাকি সমস্যা। অথচ বাসায় নতুন এসি, ফার্নিচার, ঘর সাজানোর জিনিস দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে এই কয়েকদিনে। চলে আসার সময় স্টুডেন্টকে বিদায় দিয়ে আসলাম। জানি কখনো আর ফিরবো না। দোয়া করি সে জীবনে মানুষের মত মানুষ হোক। এটাও খুব ভালো করে জানি সামনের দিনগুলো কেমন কাটবে। কিন্তু ওই যে আত্মসম্মান। বিসর্জন আর দিতে চাই না নিজের আত্মসম্মানের কাছে নিজেকে।’’

লকডাউনেও টিউশনি পড়াতে কি পরিমাণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সে সম্পর্কে নীলাঞ্জনা নীরা নামের আরেকজন লেখেন, একটু আগে বের হয়েছিলাম পড়াতে যাওয়ার জন্য। আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে অটো যা একটা পেয়েছিলাম কিছুদূর যাওয়ার পরই পুলিশের গাড়ি দেখে অটো আর যেতে চাইলো না। রাস্তায় কোনো গাড়িই চলতে দিচ্ছে না পুলিশ। বাধ্য হয়ে বাসায় চলে আসলাম। রোজা রেখে কষ্ট করে বের হলাম কিন্তু যেতে পারলাম না। অনেক খারাপ লাগতেছে, কতোদিন এমন যাবে কে জানে। কি সুন্দর সবকিছু রেগুলার ব্যাসিস এ চলছিলো, হঠাৎ লকডাউন পুরো চিত্রই বদলে দিল। আমার মাস শেষ হতে আর এক সপ্তাহ বাকি ছিলো। এখন এই সাত দিন পড়াতে যেতে না পারলে বেতন দিবে কিনা! লকডাউন আরও বাড়াবে কিনা! এগুলো নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

তবে এতো কিছুর মাঝেও রয়েছে কিছু স্বস্তির গল্প। ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক পাপন বলেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরপরই আমাকে আর বাসায় গিয়ে টিউশনি করাতে হয়নি বরং শিক্ষার্থীর অভিভাবক নিজে থেকেই অনলাইনে টিউশনি করানোর জন্য বলেছেন। অভিভাবকরা গৃহশিক্ষকদের প্রতি কিছুটা মানবিক হলে আমাদের জন্য সহজ হয়।

প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গতবছরের ১৮ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। এরপর অধিকাংশ শিক্ষার্থী বাড়ি চলে গেলেও যাদের টিউশনি বা খণ্ডকালীন চাকরি রয়েছে তারা রয়ে যান। এরপর মাঝে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমলেও এবছরের মার্চে আবারও করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এপ্রিলে সাধারণ ছুটির ঘোষণা হয়। যার ফলে এখন বন্ধ রয়েছে সব ধরনের গণপরিবহন। দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবন-জীবিকার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় থাকা খাওয়ার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা। এমন অবস্থায় তারা প্রত্যাশা করছেন গৃহ শিক্ষকদের প্রতি মানবিক আচরণ করবেন অভিভাবকরা।


সর্বশেষ সংবাদ