অনিশ্চয়তায় জীবিকা, ঢাকা ছাড়ছে মানুষ
মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে চলছে কঠোর বিধিনিষেধ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে গত ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় লকডাউন। এরপর ১৪ এপ্রিল লকডাউনের বিধিনিষেধ কঠোর করে আদেশ জারি করে সরকার, যার মেয়াদ ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে তা আরো বাড়তে পারে।
কঠোর বিধিনিষেষের মধ্যে দেশের গণপরিবহনসহ অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। জরুরি পরিষেবা ছাড়া সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষের ঘর থেকে বাহির হওয়ার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে রাজধানী ঢাকার মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাও করা হচ্ছে।
এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা। অনেকেই আবার গ্রাম থেকে ঢাকায় কাজ করতে এসে পড়েছেন বিপদে। কাজ না পেয়ে অনাহারে কাটছে তাদের দিন। কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কেউ বেতন পাচ্ছেন অর্ধেকেরও কম। তাই জীবিকার অনিশ্চয়তায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই।
রাত তখন ১১টা। রাজধানীর গাবতলী এলাকায় হাতে ব্যাগ, লুঙ্গি-শার্ট পরা একদল মানুষ দাঁড়িয়ে সড়কের ধারে। মোহাম্মদপুরের বছিলায় থেকে দিনমজুরের কাজ করতের তারা। লকডাউনে কাজ বন্ধ, খাবারের অভাব দেখা দেওয়ায় বাড়ির পথ ধরেছেন তারা। হাত তুলে থামানোর চেষ্টা করছেন দ্রুতগামী ট্রাক, অধিকাংশই থামছে না। তবে যারা থামছে ভাড়া চাইছেন বেশি। তখন হতাশমুখে রাস্তায় বসে পড়ছে ক্লান্ত দেহগুলো।
সাভারের আমিনবাজার এলাকায় মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো শত শত মানুষ। সবাই বাড়ি যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। ২০-২৫ জনের একটি দল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল। উত্তরাঞ্চলগামী পণ্যবাহী একটি ট্রাক চালকের সঙ্গে দরকষাকষি করেন তাদের তিনজন। চালক ভাড়া চাইলেন জনপ্রতি ৫০০ টাকা। তাদের কাছে এত টাকা নেই জানাতেই দ্রুত চলে গেল ট্রাকটি। ক্লান্ত শরীরে সড়কের পাশে শুয়ে পড়লেন তাদের কয়েকজন।
দলটির কয়েকজন জানান, এক সপ্তাহ আগে ধান কাটার শ্রমিক হিসেবে তারা সাভারে এসেছিলেন। তিন দিন পর কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে খেয়ে না খেয়ে কাটে আরও তিন দিন। শেষে বাধ্য হয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন তারা।
তাদের মধ্যে একজন শ্রমিক জানান, তিন দিনে মজুরি পেয়েছেন দেড় হাজার টাকা। খাওয়া-দাওয়া করে হাতে আছে ২৫০ টাকা। ভাড়া চাচ্ছে ৫০০ টাকা। এখন কেমনে বাড়ি যাবেন সেটা নিয়ে পড়েছেন চিন্তায়।
জাহাঙ্গীর মণ্ডল নামে একজন বলেন, ঈদ পর্যন্ত কাজ করে কিছু টাকা আয় করতে এসেছিলেন তিনি। বাড়িতে কিস্তি ও খাওয়ার টাকা নেই। কিন্তু এখন কোনোটাই হলো না।
হেমায়েতপুরের কাছে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো রিকশাচালকের একটি দল। তারা সবাই মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় থেকে রিকশা চালাতেন। গ্রামের বাড়ি রংপুরে। তারা জানান, ‘লকডাউন’ শুরুর পর রিকশা চালাতে বের হয়েছিলেন। পুলিশ রেকারিং করলে হাতে যে সঞ্চয় ছিল তাও শেষ হয়ে যায়। অনিশ্চয়তায় বাড়ির পথ ধরতে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তি ছয় কোটি আট লাখ। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (শ্রম আইনের সুবিধা পান এমন) কর্মরত জনশক্তি মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে বড় অংশ ৮৫ দশমিক এক শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। তাদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ কোটি দিনমজুর। যাদের শ্রম আইন-২০০৬ প্রদত্ত নিয়োগপত্র, কর্ম ঘণ্টা, ঝুঁকি ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়াসহ বেশির ভাগ অধিকারই নিশ্চিত নয়।
কাজের ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা। করোনাভাইরাস এসব মানুষের জীবিকায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। ‘লকডাউন’ দীর্ঘায়িত হলে তারা চরম খাদ্য সংকটে পড়বেন বলে সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও শ্রমবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।