পারিবারিক উদ্যোগে তৈরি বায়তুল মোকাররম যেভাবে জাতীয় মসজিদ হয়ে উঠে
বাংলাদেশে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে রমজানের তারাবিহর নামাজের সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী সীমিত পরিসরে তারাবিহর নামাজ শুরু করা হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় ধর্ম মন্ত্রণালয় তারাবিহর নামাজও সীমিত পরিসরে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে।
তাতে বলা হয়, তারাবিহর নামাজে খতিব, ইমাম, হাফেজ এবং খাদিমসহ সর্বোচ্চ ২০ জন মুসল্লির অংশ নিতে পারবেন। এছাড়াও মহামারি পরিস্থিতিতে এবার সাধারণ মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজনও করা হচ্ছে না।
বায়তুল মোকাররমের একজন খতিব জানিয়েছেন, তারা রমজান শুরুর অনেক আগেই তারাবিহসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কারণ তারাবিহর নামাজের সব চেয়ে বড় জামাত বায়তুল মোকাররম মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
তিনি বলেছেন, করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে গতবছরের মতো এবারও বায়তুল মোকাররমে তারাবিহর নামাজ এবং রমযান উপলক্ষে প্রতিদিন দুপুরে ও বিকেলে ধর্মীয় আলোচনা সীমিত পরিসরে করতে হচ্ছে।
পারিবারিক উদ্যোগে এই মসজিদ
ষাট বছরেরও বেশি সময় আগে একটি পরিবারের উদ্যোগে প্রায় সাড়ে আট একর জমির ওপর নির্মিত এই মসজিদ বাংলাদেশের মুসলিমদের কাছে মর্যাদার স্থান হয়ে উঠেছে। মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে মক্কার কাবা ঘরের আদলে চারকোনা আকৃতির। পুরোনো এবং নতুন ঢাকার মিলনস্থল পল্টন এলাকায় এই মসজিদে একসঙ্গে চল্লিশ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। দেশের বৃহত্তম এই মসজিদের ইতিহাস এবং গুরুত্ব নিয়ে অনেক বইও প্রকাশ করা হয়েছে।
বায়তুল মোকাররম নির্মাণের উদ্যোগ
পাকিস্তান আমলে ঢাকায় বড় শিল্প উদ্যোক্তা বাওয়ানি পরিবারের পক্ষ থেকে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। বাওয়ানি জুট মিলসের মালিক উর্দূভাষী আব্দুল লতিফ বাওয়ানি এবং তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানি ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠন করে মসজিদটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন ১৯৫৯ সালে।
ইতিহাসবিদ শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ-এ বলা হয়েছে, ১৯৬০ সালের ২৭শে জানুয়ারি আব্দুল লতিফ বাওয়ানি মসজিদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর দুই বছর পর ১৯৬২ সালে মসজিদ নির্মাণের কাজ মোটামুটি শেষ হয়। তবে পুরো কাজ শেষ হয় ১৯৬৮ সালে। মসজিদটির নকশা করেছেন পাকিস্তানের সিন্ধুর একজন স্থপতি এ এইচ থারানি।
মসজিদের জায়গা
ইসলামিক ফাউণ্ডেশন এই মসজিদের ইতিহাস নিয়েই একটি বই প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রায় সাড়ে আট একর জমির ওপর এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। সেই ষাটের দশকের শুরুতে এই জায়গা অধিগ্রহণ করার পর যখন মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়, তখন সেখানে একটি বড় পুকুরও ছিল। সেটা পল্টন পুকুর নামে পরিচিত ছিল। পুকুরটি ভরাট করার পর মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছিল।
যে কারণে পল্টনে এই মসজিদ
বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মিত হয়েছে পুরোনো ঢাকা এবং নতুন ঢাকার মিলনস্থলে। ইসলাম নিয়ে লেখক ওসমান গণি বলেছেন, এই মসজিদ নির্মাণের অনেক আগে থেকেই নতুন ঢাকার সীমানা বাড়তে থাকে। ফলে পুরোনো ও নতুন- দুই ঢাকার মানুষের কথা এই জায়গা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় বিবেচনার বিষয় ছিল বলে তিনি মনে করেন।
ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বায়তুল মোকাররমের ঐ জায়গাটিকে তখন নগরীর কেন্দ্রস্থল হিসাবেও বিবেচনা করা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা এমন ধারণা করেন।
মসজিদের ভিতরে যা আছে
বায়তুল মোকাররম মসজিদটি প্রথমে ত্রিশ হাজার মানুষের নামাজ আদায়ের সুযোগ রেখে নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে ২০০৮ সালে সৌদি সরকারের অর্থায়নে এর সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এর ফলে একসঙ্গে ৪০,০০০ মানুষের নামাজ আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মসজিদের মূল ভবনটি আটতলা, যা মাটি থেকে ৯৯ ফুট উঁচু। আটতলা এই মসজিদের নিচতলায় মার্কেট এবং গুদাম ঘর রয়েছে।
দোতলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় নামাজ পড়া হয়। আর খতিব বা ইমাম নামাজ পড়ান দোতলা থেকে। তিনতলার উত্তরপাশে নারীদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে। সেখানে একসঙ্গে ১৫০০ নারী নামাজ পড়তে পারেন। উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্ব দিক থেকে মসজিদে প্রবেশ করা যায়।
বায়তুল মোকাররমের খতিব মিজানুর রহমান বলেছেন, শুক্রবারে জুম্মার নামাজে এই মসজিদে উপচে পড়া ভিড় হয়। আর প্রতি ঈদে পাঁচটি করে জামাত হয় এবং প্রতি জামাতেই থাকে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ। তিনি উল্লেখ করেছেন, দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটকও আসেন বায়তুল মোকাররম মসজিদ দেখার জন্য।
বায়তুল মোকাররম মসজিদের নকশা বা স্থাপত্য শৈলীর মাঝে ভিন্ন ধরণের আকর্ষণ রয়েছে। প্রথম রোজা থেকেই করা হয় ইফতারের আয়োজন। সরকারের ইসলামিক ফাউণ্ডেশন এই ইফতার আয়োজনের অর্থায়ন করে।
বায়তুল মোকাররম মসজিদে সিনিয়র খতিব মিজানুর রহমান বলেছেন, রমজান মাসে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। ধনী, গরিব-সব শ্রেনির মানুষ এক সাথে বসে ইফতার করে থাকেন।
কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গত বারের মতো এবারও ইফতারের আয়োজনা বন্ধ রাখা হয়েছে। শেষ দশ রোজায় শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজের জামাতের আয়োজনও করা হয়। খতিব মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তাহাজ্জুদের নামাজেও অনেক মুসল্লি অংশ নেন। এগুলো সবই গত বছর থেকে সীমিত পরিসরে করা হচ্ছে মহামারির কারণে। প্রতি ঈদে কয়েকটি জামাতে বায়তুল মোকাররমে লাখো মানুষ নামাজ পড়েন। [সূত্র: বিবিসি বাংলা]