০৬ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪৫

অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে গুগল-ইউটিউব ভরসা শিক্ষার্থীদের, উধাও বই

করোনকালে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে  © প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মাধ্যমিকসহ সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। র্দীঘদিন বন্ধ থাকায় বছর প্রথমে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মূল্যায়ন করা হয় অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতিতে। যাদের বাড়িতে স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত ছেলে-মেয়ে আছে, তারা এরইমধ্যে বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন অ্যাসাইনমেন্ট শব্দটির সাথে।

অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের লক্ষে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অনলাইনের মাধ্যমে গুগল এবং ইউটিউবে সার্চ করছে অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কিত নানা বিষয়। অর্থাৎ যাদের কাছে অ্যাসাইনমেন্টের নানা ইস্যু বা যে বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে, তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই- তারা গুগল অথবা ইউটিউবের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এতে না পড়েই অ্যাসাইনমেন্ট লেখার একটি ধারণা চলে আসছে তাদের মাঝে।

নোয়াখালীর বেশ কিছু স্কুল শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে কিছুই জানে না। এজন্য তারা গুগল এবং ইউটিউব থেকে সাহায্য নিচ্ছে। স্থানীয় সুলতানপুর হানিফ ভূঁইয়া স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ঐশি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানায়, ‘দীর্ঘদিন বাসায় আছি। পড়াশোনা বেশি করা হচ্ছে না। স্কুল থেকে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্টের কিছুই বুঝি না। তাই গুগল থেকে দেখে দেখে লিখছি।’

আরেক শিক্ষার্থী জানায়, ‘সকল বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্ট চাইলে আমরা ইউটিউব থেকে লিখতে পারি। তাই আর বই পড়তে হচ্ছে না।’

এদিকে প্রায় এক বছর ধরে স্কুল ও ক্লাসরুম থেকে দুরে থাকা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক নতুন ও পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সাথে পরিচিত হতে হয়েছে। জুম, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ক্লাস, গুগল ক্লাসরুমে অ্যাসাইনমেন্ট, যাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সামর্থ্য নেই তারা শিক্ষকদের সাথে ফোনকল করছে। সর্বশেষ যে পদ্ধতির সাথে শিশুরা পরিচিত হলো সেটি হলো অ্যাসাইনমেন্ট।

জানা গেছে, ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত এ পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা। তবে অনেক বেসরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি থেকেই অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে একটি করে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দেয়ার কথা।

লক্ষিপুর জেলার সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান প্রতাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সপ্তাহের শুরুতে একদিন শিক্ষার্থী বা শিক্ষার্থীর অভিভাবক অথবা পরিবারের অন্য কোন প্রতিনিধি স্কুলে গিয়ে সেই অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসবেন।সেসময় অভিভাবকদের ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকরা কথা বলেন।

তিনি জানান, একইভাবে সপ্তাহের শেষে স্কুলে গিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেন অভিভাবকেরা। বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের প্রত্যেককে আলাদা সময় দেয়ার কথা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নে শিক্ষক কোন নম্বর দেন না। বরং শিক্ষার্থীর কাজের মান সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়। আর আমরা এটা আপতত সংগ্রহ করছি সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী। পরবর্তীতে যে ব্যবস্থা নিতে বলা হয় সেটা করা হবে।

ঢাকার লালমাটিয়ার একটি স্কুলের শিক্ষার্থীর মা বলছেন, ‘আগে যেভাবে বাচ্চার পড়াশুনায় তাদের সাহায্য করতে হতো তার চেয়ে এখন অনেক বেশি সময় ও মনোযোগ দিতে হয়। মোট ছয়টি বিষয় পড়ানো হয় তার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সন্তানের ক্লাসে। সবগুলো বিষয়ের উপর সপ্তাহে একটি করে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে স্কুল থেকে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের একটি করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে।’

তিনি বলছেন, ‘আগে জুমে ক্লাস হতো, এখন শুধু হোয়াটসঅ্যাপে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে। শনিবার অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তা জমা দিতে হয়। আগে ভিডিও কলে সরাসরি কথা হতো। কারো প্রশ্ন থাকলে করতে পারতো। এমনিতেই বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না। এ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর আমার মনে হয় বাচ্চাদের সাথে স্কুলের যোগাযোগ যেন আরও কমে গেছে।’

কতটা কাজে আসছে এই পদ্ধতি?
অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি চালুর আগে সরকার যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, মার্চে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সংসদ টেলিভিশন, অনলাইন ক্লাস, মোবাইল ফোন ও কিশোর বাতায়নের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার চেষ্টা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তির ভাষায়, ‘হঠাৎ করে নতুন ধরনের শিখন-শেখানো কার্যক্রম চালু করাতে অনেক শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় শিখনফল অর্জন করতে পারেনি। র্দীঘদিন পরিক্ষা থেকে বিরত থাকায় শিক্ষার্থীরা যেন তাদের মেধা যাচাইয় করতে পারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর স্ব-শরীরে পরিক্ষা নেওয়া হলে তারা যেন প্রস্তুত হতে পারে সেই বিষয়টি বিবেচনায় এনে তাদের পাঠ্যসূচী পুনর্বিন্যাস এবং অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

এদিকে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের নেতা জিয়াউল কবির দুলু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘র্দীঘদিন শিক্ষার্থীরা ক্লাস পরীক্ষা থেকে বিরত থাকায় তাদের মেধা যাচাইয়ের জন্য অ্যাসাইনমেন্ট একটি অস্থায়ী বিকল্প ব্যবস্থা। কারণ এছাড়া আর কোন উপায় নেই। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমরা এগুচ্ছি, থেমে নেই।’

গুগল এবং ইউটিউব থেকে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর লেখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা ধ্বংস করছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবী যেসকল ইউটিউব চ্যানেল এবং ওয়েবসাইট থেকে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের মেধা ধ্বংস করা হচ্ছে, সে গুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তবে ভিন্নমত পোষণ করছেন শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান। তিনি এ ব্যবস্থার সাথে একমত হতে পারছেন না। তিনি বলছেন, ‘কারণ শিক্ষার্থীদের আমরা শেখাব। শেখার চাইতে মূল্যায়নের গুরুত্ব বেশি না। মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচী থেকে যে জ্ঞান অর্জন করতে পারার কথা তারা সেটা পারেনি। নামকাওয়াস্তে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে তাদের মূল্যায়ন হবে। এই অ্যাসাইনমেন্ট বাড়িতে সে নিজে করছে, নাকি তার অভিভাবক, প্রাইভেট টিচার বা বড় ভাই করে দিচ্ছে সেটা বোঝার কোন উপায় আছে?’

তিনি আরো বলেন, ‘শেখাতে পারলাম না, কিন্তু তাকে পরবর্তী ক্লাসে উঠিয়ে দিলাম। এতে বিশাল লার্নিং গ্যাপ তৈরি হবে। এই শিখন শূন্যতা নিয়ে পরের ধাপের আরও উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে না। কারণ উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করতে হলে তাকে আগের বিষয়গুলো জানতে হবে। সেটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে হবে না।’