লাশের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা, প্রস্তুত হচ্ছে কবর

কবর খনন
কবর খনন  © সংগৃহীত

রাজশাহীর কাটাখালীতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নারী ও শিশুসহ নিহত ১৭ জনই রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। শুক্রবার (২৬ মার্চ) বিকেলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিহতের বাড়ি বাড়ি পড়ে কান্নার রোল। ঘটনার একদিন পর এখন লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসী।

শনিবার (২৭ মার্চ) পৌনে ৯টার দিকে পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় রাজারামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিহতের স্বজনরা কবর খোঁড়াখুঁড়িতে ব্যস্ত। কেউ করছেন বাঁশ কাটাকাটি। ঘরে ঘরে চলছে কোরআন তিলাওয়াত। চারদিকে শোকাবহ পরিবেশ। লাশের অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর চোখ তখনও অশ্রুসিক্ত। রাতভর স্বজন হারানোর শোকে আহাজারি করতে করতে এখন তারা যেন শোক জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।

বড় রাজারামপুর গ্রামে একই পরিবারের পাঁচজন রাজশাহীর ওই দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। তারা হলেন- রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিন (৩৬), তার স্ত্রী সামছুন্নাহার (২৮), ছেলে সাজিদ (৭), মেয়ে সাফা (৪) এবং সামছুন্নাহারের বড় বোন কামরুন্নাহার (৪১)। এই পরিবারের পাঁচজনের মধ্যে কামরুন্নাহারের স্বামী শাহজাহান মন্ডল তোতা ২০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর থেকেই একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসান তুবাকে নিয়ে বাবা আব্দুল করিম সরকারের বাড়িতে থাকতেন কামরুন্নাহার।

জানা যায়, আব্দুল করিম সরকারের জামাই নিহত সালাহউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি একই উপজেলার চৈত্রকোল ইউনিয়নের রাঙ্গামাটি গ্রামে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে পীরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। ঘটনার দিন ওই মাইক্রোবাসে সালাহউদ্দিনসহ তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে এবং বড় শ্যালিকা কামরুন্নাহার ছিলেন।

নিহত সালাহউদ্দিনের চাচাতো ভাই নুরুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার খবর শুনে শুক্রবার রাতে নিহতদের মরদেহ আনার জন্য তাদের পরিবারের তিনজন ইতোমধ্যে রাজশাহীতে পৌঁছেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঁচটা লাশের মধ্যে তিনজনকে শনাক্ত করতে পেরেছেন তারা। বাকিদের এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

তিনি আরও বলেন, নিহতদের মরদেহ পীরগঞ্জে আসার পর জানাজার নামাজ ও দাফনের ব্যাপারে সময় নির্ধারণ করা হবে। তবে সকাল থেকে বাড়ির পাশেই কবর খোঁড়াখুঁড়িসহ অন্যান্য কাজগুলো করা হচ্ছে।

একই ইউনিয়নের বড় মজিদপুর গ্রামে আরও একটি পরিবারের পাঁচজন মারা গেছেন রাজশাহীর ওই দুর্ঘটনায়। সেখানকার নিহতরা হলেন- মৃত জনাব আলীর ছেলে ফুল মিয়া (৪০), তার স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৫), মেয়ে সাবিয়া (৪), সুমাইয়া (৮) ও ছেলে ফয়সাল (১৩)। তারা সবাই দুর্ঘটনা কবলিত মাইক্রোবাসে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।

বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মা সাহিদা বেগমের সঙ্গে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নানার বাড়িতে থাকতেন ফুল মিয়া। এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম কর্তা ছিলেন ফুল মিয়া। কিন্তু রাজশাহীতে বেড়াতে গিয়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ফুল মিয়ার সাজানো সংসার নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। ফুল মিয়ার বৃদ্ধা মা সাহিদা বেগম বাড়িতে থাকায় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছেন। সকাল ১০টার দিকে ওই বাড়িতে দেখা যায়, ফুল মিয়ার মা, ভাইসহ আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তাদের বুকফাটা আহাজারি দেখে গ্রামের লোকজনও কান্না করছেন।

সেখানে কথা হয় ফুল মিয়ার মামা মাদরাসাশিক্ষক আব্দুস ছালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ফুল মিয়াকে গ্রামের সবাই খুব ভালোবাসে। সবার কাছে খুব ভালো মানুষ ছিল। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করেছে। একসময় গ্রামে গ্রামে হাড়িপাতিল বিক্রি করেছে। অনেক কষ্টে সংসারটা গুছিয়েছিল। বৃদ্ধা মাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটছিল ওর। কিন্তু কী যে হলো। একটা দুর্ঘটনায় স্ত্রী-সন্তানসহ জীবনটা শেষ হলে গেল। এতো বড় শোক সইতে পারছি না।

নিহত ফুল মিয়ার ছোট ভাই সুজন মন্ডল বলেন, বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে আমাদের পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ থাকল না। আগে বাবাকে হারিয়েছি। ভাইকে হারিয়ে যেন সব কিছুই হারালাম। লাশ নিতে যাওয়ার মতো আমাদের তো কেউ নেই। গ্রামের মেম্বার রাজশাহী গেছেন। লাশ আসার পর দাফনের ব্যবস্থা হবে। এখন শুধু কবর খোঁড়াখুঁড়ি করে রাখা হচ্ছে। জানাজার সময়টা এখনো ঠিক করা হয়নি। আমরা সবাই লাশের অপেক্ষায় আছি।

পীরগঞ্জ পৌর এলাকার প্রজাপাড়ার বাসিন্দা তাজুল করিম ভুট্টু (৪৫)। তিনি পেশায় স্যালো মেকার। ব্যবসায়ী বন্ধু ফুল মিয়ার আমন্ত্রণে পরিবারের সবাইকে নিয়ে তিনিও সঙ্গী হয়েছিলেন রাজশাহী ভ্রমণ যাত্রায়। কিন্তু ওই মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ভুট্টুসহ তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (৩৫) ও ছেলে ইয়াসিন (১৪) মারা গেছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রজাপাড়ায় ভুট্টুর বাড়িতে দেখা যায় স্তব্ধ পরিবেশ। ওই বাড়িতে কান্নাকাটি করার মতো কেউ নেই। পরিবারের সব সদস্যই নিহত হওয়ায় সেখানে আর কেউই নেই আহাজারি করার জন্য।

নিহতদের ব্যাপারে পীরগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরেস চন্দ্র বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত ১৭ জনের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রয়েছে। এদের মধ্যে ১১ জনের মরদেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। নিহতদের পরিবার থেকে অনেকেই রাজশাহীতে মরদেহ গ্রহণ করতে গিয়েছেন। কিন্তু ডিএনএ নমুনা নিয়ে মরদেহ শনাক্ত করাসহ আইনি প্রক্রিয়া শেষে দ্রুত মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করবেন মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। এসব মরদেহ পীরগঞ্জে কখন আনা হবে, তা এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

রাজশাহী মহানগর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে ওসি সরেস চন্দ্র বলেন, ওই দুর্ঘটনায় বাসচালককে আসামি করে কাটাখালী থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। দুর্ঘটনার পর থেকেই বাসচালক পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

শুক্রবার (২৬ মার্চ) দুপুর পৌনে ২টার দিকে নগরীর কাটাখালী থানার সামনে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কে বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মাইক্রোবাসে আগুন লেগে যায়। দুর্ঘটনার পর আটজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এদের মধ্যে ছয়জন মারা যান। পরে আগুনে পোড়া মাইক্রোবাস থেকে নারী ও শিশুসহ ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৭ জন মারা গেছেন। এরা সবাই মাইক্রোবাসের আরোহী ছিলেন। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া পাভেল (১৯) নামে এক মাইক্রোবাস আরোহী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।


সর্বশেষ সংবাদ