শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রোডম্যাপ এখনো চূড়ান্ত হয়নি
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারি কারণে গত বছর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়নি পাবলিক পরীক্ষাগুলো। অনলাইনে বা টেলিভিশনে বিকল্প শিক্ষাদানের চেষ্টা হলেও তাতে সাফল্য এসেছে কমই। আর এসব কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা এখনো যেমন চূড়ান্ত হয়নি, তেমনি কবে স্কুল কলেজ খুলবে তাও এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি সরকার।
উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুরের একটি সরকারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী রুয়াইদা রহমানের মা রুহ আফজা রাজ্জাক বলছেন, প্রায় নয় মাস ধরে স্কুলে যেতে পারছেনা তার মেয়ে। ফলে এই শিক্ষাবর্ষের অনেক কিছুর সাথে পরিচিত না হয়েই তাকে পরবর্তী ক্লাসে উঠতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘স্কুলের যে একটা সার্বিক পরিবেশ। অনেকগুলো বাচ্চার সঙ্গে মেশা ও শেখা। এখন বাসায় পড়ানোর চেষ্টা করলেও দেখা যায় তার আগ্রহ নেই। পরীক্ষা হচ্ছেনা অনেক দিন ধরে। পরীক্ষা কিভাবে হয় সেটাই আসলে তার মনে নেই। পড়ার যে আগ্রহ সেটা অনেকটাই কমে গেছে। এমনকি তার আচরণেও পরিবর্তন হচ্ছে।’ ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে একযোগে পড়ার মাধ্যমে যে শিক্ষণ প্রক্রিয়া সেটি না থাকায় এ বছরে তার যা যা শেখা উচিত তার অনেকখানিই হয়নি বলে মনে করছেন এই অভিভাবক।
বিবিসির বাংলার বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কবে খুলবে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়- বাংলাদেশে এ প্রশ্নের উত্তর এখনো কারও জানা নেই। এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেছেন সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা তারা করছেন, কিন্তু সেটি কবে নাগাদ হবে, তা নির্ভর করবে করোনা পরিস্থিতি ভালো হওয়ার পর। অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার কোনো কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ এখনো চূড়ান্তই করতে পারেনি সরকার। আবার পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেয়া গেলে এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেয়া হচ্ছেনা কেন এসব প্রশ্নেরও কোনো জবাব নেই কারও কাছে।
তবে মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, মূলত করোনা ভ্যাকসিন আসার পর পরিস্থিতি দেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায় কি-না পর্যালোচনা করা হবে। তাছাড়া এখন স্কুল খোলার বিষয়ে অভিভাবকদের দিক থেকেও বড় ধরণের অনীহা আছে বলে মনে করছে সরকার। ওদিকে শিক্ষামন্ত্রী যা বলেছেন তাতে শুধুমাত্র দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে নিয়ে আসার কথা উঠে এসেছে যারা সামনে এসএসসি ও এইচএসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।
তিনি বলেছেন, ‘সীমিত আকারে শ্রেণী কার্যক্রম শুরু নিয়ে ভাবছি। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আসলেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা করছি। আগামী জুন নাগাদ আশা করছি এসএসসি বা সমমান পরীক্ষা গ্রহণ করতে পারবো। পাশাপাশি অনলাইন কার্যক্রমও অব্যাহত থাকবে। সীমিত পরিসরে স্কুল কলেজ খুলে দেয়ার চেষ্টা করবো। বিশেষ করে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণী তারা যেন ক্লাসরুমে ক্লাস করে পরীক্ষা দিতে পারে সেরকম ব্যবস্থা আমরা করতে চাই।’
গত বছরের সতেরই মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি দফায় দফায় বাড়িয়ে সর্বশেষ আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে করোনার কারণে এখন আর কোনো কিছুর কার্যক্রমই বন্ধ নেই। রাস্তাঘাট, হাট বাজার, যানবাহনে উপচেপড়া ভিড় মানুষের। এমনকি আগেই খুলে দেয়া মাদ্রাসাগুলোও চলছে। বন্ধ আছে শুধু সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে এ দীর্ঘ ছুটির সময়ে বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো তাতেও শতভাগ সফলতা আসেনি। গাজীপুরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা আকলিমা খাতুন বলেন, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে অর্থাৎ বিকল্প পদ্ধতিতে তারা চেষ্টা করেছেন পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার কিন্তু সেটি ছিলো অনেকটা জরুরি অবস্থা মোকাবেলার মতো।’
তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা হলে আমরা সরাসরি মূল্যায়ন করি। ক্লাসে খাতা দেখি, আলোচনা করি, মূল্যায়ন করি। কিন্তু এবার প্রশ্ন দিয়ে দিলাম। বাড়ী থেকে খাতা এনে মূল্যায়ন করলাম। তাতে তো আগের মতো হয়নি। অনলাইনে সিলেবাস দিয়ে পড়া নিচ্ছি, দিচ্ছি, গার্ডিয়ানের সাথে কথা হচ্ছে, অভিভাবকরা খাতা দিয়ে যাচ্ছে, আমরা দেখছি।’
সরকার গত মার্চে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর ঈদসহ নানা ছুটির কারণে মে মাস থেকে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কাজ শুরু করে অনেক স্কুল। পরে স্কুল কবে খুলবে তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় ঢাকার অনেকগুলো স্কুলে অনলাইনে শিক্ষাদান শুরু করলেও ঢাকার বাইরে যেখানে ইন্টারনেট আছে সেখানে রেকর্ডেড ক্লাসগুলোই পেয়েছে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা।
আকলিমা খাতুন বলছেন, শিক্ষক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা বলছে এতে ঠেকার কাজ চলেছে কিন্তু বাস্তবের তুলনায় এটি ছিলো খুবই স্বল্প পরিসরের উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘বাস্তবে তো পরীক্ষা নিতাম। এবার যারা ৪র্থ থেকে পঞ্চমে উঠলো তারা তো প্রশ্নের সাথে পরিচিতই হতে পারলোনা। সৃজনশীল যে প্রশ্ন তাদের দেখার কথা সেটি তারা দেখতেই পারেনি। পুরো বছরে তাদের কোনো পরীক্ষাই হয়নি। ফলে এক বছর গ্যাপ দিয়ে যখন পঞ্চম শ্রেণীতে উঠবে তখন তাদের কাছে বোঝা হয়ে যাবে এটা।’
যদিও অনলাইনের পাশাপাশি টেলিভিশনে তৃতীয় শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠদানের চেষ্টা হয়েছে। অনেক স্কুল আবার নিজেদের ফেসবুক বা ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিনকার ক্লাসগুলো আপলোড করে দিয়েছে। যদিও অনলাইন বা বিকল্প শিক্ষাদান পদ্ধতি সারাদেশর শতভাগ শিক্ষার্থীকে আনা যায়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নিজেই।
ঢাকার একজন অভিভাবক তাহমিনা পলি বলছেন, তার দু’সন্তান স্কুলে পড়ছে। স্কুলগুলো অনলাইনে চেষ্টা করলেও এ বছর জানা উচিত ছিলো এমন অনেক কিছু অজানা রেখেই পরবর্তী শ্রেণীতে উঠতে হবে তাদের।তিনি, ‘পড়াশোনা পরীক্ষার পাশাপাশি কো কারিকুলাম কার্যক্রম থাকে সেগুলো থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছে বাচ্চারা। স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া যেটি আমার দুই বাচ্চা স্বাভাবিকভাবে যতটুকু জানার কথা তা থেকে পিছিয়ে আছে। অনলাইনে হয়তো সিলেবাস শেষ করেছে কিন্তু সেটা করা হয়েছে বেছে বেছে। ফলে একটা পাঠের সাথে আরেকটার যে লিংক সেটা বাচ্চারা ধরতেই পারেনি অনেক ক্ষেত্রে।’
এদিকে ক্লাস পরীক্ষা না হওয়ায় মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করে অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এবং সে কার্যক্রম এখন চলছে। তবে অনলাইনের অপর্যাপ্ত শিক্ষাদান, শিক্ষকদের সাথে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া না থাকা, সিলেবাস অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক পাঠ কার্যক্রম পরিপূর্ণ শেষ না হওয়ার জের ধরে প্রথম শ্রেণী থেক শুরু করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-সর্বত্রই শিক্ষায় একটি বড় ঘাটতি থেকে যাওয়ার আশংকা করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ক্লাসের বিষয় পুরোপুরি শেষ না করলে পরের ক্লাসে গিয়ে অনেক কিছুই বুঝবে না। না বুঝেই মুখস্থ করতে চাইবে। সব বিষয়ের মধ্যে আগের ক্লাস বা পাঠের সম্পর্ক থাকে। বলতে গেলে ২০২০ সালে যে যেই ক্লাসের সেই ক্লাসের যা শেখার কথা শিখলোনা। তো সে পরের বছর পরবর্তী ক্লাসে গিয়ে তো বুঝতে পারবেনা। এক পর্যায়ে হয় ড্রপ আউট হবে না হয় ফেল করতে করতে যাবে।’
আবার ২০২০ সালের শিক্ষায় এ ঘাটতির পাশাপাশি সামনে যোগ হবে ২০২১ সালের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর চ্যালেঞ্জ। আরেকজন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার বলছেন, ঘাটতি যাতে কম হয় সেজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এটি সত্য। কিন্তু বাংলাদেশে ইন্টারনেট অবকাঠামো কিংবা নানা কারণে শিক্ষার্থীরাও অনেকে তার সুবিধা নিতে পারেনি।
তিনি বলেন, ‘একটা সিলেবাস কেন করা হয়। সে লেভেলে শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে। পর্যালোচনা করে বিষয়গুলো সেখানে রাখা হয় যেটা তাদের প্রয়োজন বা বয়সের সাথে সম্পৃক্ত। এটা ভিত তৈরি করবে উপরের লেভেলে পড়াশোনা বা বোঝার জন্য। এটা তো বড় গ্যাপ তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, শিক্ষক যদি সব পূর্ণাঙ্গ কারিকুলাম না বোঝে তাহলে পরেও এই সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে কারণ পরিস্থিতি ভালো হলে স্কুল কলেজ খুললে শিক্ষককে আগে বুঝতে হবে যে শিক্ষার্থী আগের বছরে কোন বিষয়গুলো জানার সুযোগ পায়নি। তবে এজন্য খুলতে হবে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু পরিস্থিতি ভালো হলেও শিক্ষায় বিদায়ী বছরের ঘাটতি পোষানো হবে কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেছেন, ঘাটতিগুলো নিরূপণের জন্যই শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে তারা সামনে ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করবেন। তিনি বলেন, ‘কোথায় ঘাটতি হয়েছে সেটা বুঝতে পারবো বলে আশা করি। সে অনুযায়ী ২০২১ সালের সিলেবাস, কতটা রেমিডিয়াল ক্লাস নিবো সেটা তার ওপর নির্ভর করবে। শিক্ষার্থীদের যখন ক্লাসে আনবো তখনও নানা অ্যাসেসমেন্টের মধ্যে নিয়ে যাবো এবং ঘাটতি পূরণে সর্বোচ্চ করবো। হয়তো এক শিক্ষাবর্ষে ঘাটতি পূরণ করা যাবে না, সেক্ষেত্রে একাধিক শিক্ষাবর্ষ মিলিয়ে ঘাটতিগুলো পূরণের চেষ্টা করবো।’
এদিকে বিদায়ী বছরে যে এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি বিশেষ ব্যবস্থায় তার ফল প্রকাশ হবে জানুয়ারির শুরুতে। তবে পিছিয়ে যাবে ২০২১ সালের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা। এর মধ্যেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২১ শিক্ষাবর্ষের বই বিতরণ শুরু হয়েছে। যদিও সে বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা আবার কবে থেকে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারবে সেটি কারও জানা নেই।