২৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৬

অটোপাসের বছরে ঘরবন্দী শিক্ষার্থীরা, বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীরা

  © ফাইল ফটো

করোনার কারণে ২০২০ সালটি শিক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্পূর্ণ। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্টের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, ভার্চুয়াল মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়া, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বারের মতো এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাস দেয়া, বড় কয়েকটি চাকরির পরীক্ষা বাতিল হওয়া, দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বছরজুড়েই আলোচনার তুঙ্গে ছিল শিক্ষা। বছরের শেষ দিকে হল খোলার দাবিতে আন্দোলনও নজর কেড়েছে সবার।

কভিড-১৯ এর কারণে এ বছর প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সব পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। পিএসসি-জেএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দেয়া হয়েছে অটোপাস। দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোয় ঘরবন্দী অবস্থাতেই পার হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের চলতি শিক্ষাবর্ষ। এদিকে অটোপাস দেয়ায় প্রাথমিক থেকে শুরু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পার পেয়ে গেলেও থমকে গেছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন। পরীক্ষা না হওয়ায় একই বর্ষে থেকে চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে হচ্ছে তাদের।

দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এর পর ওই মাসেরই ১৭ তারিখ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কমিয়ে আনতে সংসদ টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে পাঠদান অব্যাহত রাখা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে না পারায় জেএসসি ও মাধ্যমিকের সব শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করে সকলকেই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়। এছাড়া এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে করোনার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন থমকে গেছে। এই স্তরের শিক্ষার্থীদের গত জুলাই মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করে সংশ্লিষ্টরা। ভার্চুয়াল মাধ্যমে ক্লাস নিলেও নানা অজুহাতে পরীক্ষা নিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে স্নাতক বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সেশনজটে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে চলতি শিক্ষাবর্ষে  শিক্ষায় এক ধরণের বৈষম্য তৈরি হয়েছে বলে অভিমত শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, করোনার কারণে সকল সেক্টরই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে শিক্ষায় ক্ষতিটা বেশি। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লসটা সবচেয়ে বেশি। কেননা তারা অনলাইনে ক্লাস করলেও পরীক্ষা না হওয়ায় তাদের শিক্ষাজীবন থমকে গেছে। এছাড়া দীর্ঘ সেশন জটের শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

ক্ষতি কমাতে করোনা পরবর্তী সময়ের কর্ম পরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখনি ঠিক করা উচিত জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় তাদের একাডেমিক কাউন্সিল। ফলে করোনা পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে সেটির পরিকল্পনা তাদের এখনি করা উচিত। নইলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। ক্ষতি কমাতে সপ্তাহে সাতদিন ক্লাস, ধারাবাহিকভাবে পরীক্ষা নেয়া, ছুটি কমিয়ে আনাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়া হবে তখন থেকেই যেন এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায় সেজন্য এই পরিকল্পনা করা দরকার।

সংসদ টিভিতে ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্ট

গত ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদান শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। করোনার প্রকোপ কমে না আসায় মাধ্যমিকের সব শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এমনকি বাতিল করা হয় জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও। শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত নভেম্বর মাসে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ৩০ কর্মদিবসের একটি পুনর্বিন্যাসকৃত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শিক্ষার্থীদের পঠন জ্ঞান অর্জনে ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য সপ্তাহে ৩টি করে মোট ১৮ টি অ্যাসাইমেন্ট তৈরি করা হয়েছে।

এইচএসসিতে অটোপাস

২০২০ সালের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে এইচএসসিতে অটোপাস। সীমিত পরিসরে পরীক্ষা নিতে চেয়েও শেষ মুহূর্তে সংবাদ সম্মেলন করে অটোপাসের সিদ্ধান্ত জানান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গত ৭ অক্টোবর এইচএসসিতে অটোপাসের ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষার্থীদের জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট গড় করে এইচএসসির ফলাফল দেয়া হবে বলে জানানো হয়। চলতি ডিসেম্বর মাসে এই রেজাল্ট দেয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে।

বৈষম্যের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

করোনার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন থমকে গেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিতে পারলেও নানা জটিলতায় পরীক্ষা নিতে পারেনি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী একই বর্ষে থেকেই একটি শিক্ষাবর্ষ সমাপ্ত করতে যাচ্ছে। অন্যদিকে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। এটিকে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বলেই মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

বিসিএসেও স্থবিরতা

করোনার কারণে এবছর বিসিএস কার্যক্রমেও এসেছে স্থবিরতা। পিএসসি’র নিয়োগ কার্যক্রমের ধীরগতি নিয়ে প্রার্থীদের অভিযোগ যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে করোনা। প্রায় এক বছর হতে চললেও এখনো ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারেনি পিএসসি। এছাড়া আটকে রয়েছে ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের কাজও। তবে এতকিছুর মধ্যেও বছরের শেষ দিকে দুই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি এক সঙ্গে প্রকাশ করে আলোচনার জন্ম দেয় পিএসসি। গত ৩০ নভেম্বর ৪২তম (বিশেষ) ও ৪৩তম (সাধারণ) বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি।

চাকরির বাজারে করোনার থাবা

করোনার ভয়াল থাবা পড়েছে চাকরির বাজারেও। কভিড-১৯ এর কারণে চলতি বছর বড় কয়েকটি চাকরির পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সমন্বিত সাতটি ব্যাংকের পরীক্ষা উল্লেখযোগ্য। কয়েক দফায় পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেও পরীক্ষা আয়োজন করতে পারেনি ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি। বছরের শেষ দিকে এসে ছোট ছোট কয়েকটি চাকরির পরীক্ষা হলেও সেগুলো যথেষ্ট ছিল না বলে দাবি চাকরি প্রার্থীদের। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদশূন্য থাকলেও চাকরির পরীক্ষা আয়োজন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন কিনে দিতে ইউজিসি’র শিক্ষাঋণ

শিক্ষা ক্ষেত্রে চলতি বছরের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন কিনে দেয়ার উদ্যোগ। যে সকল ছাত্র-ছাত্রীর অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত থাকার মতো ডিভাইস নেই তাদের আট হাজার টাকা করে শিক্ষাঋণ দেয়ার উদ্যোগ নেয় ইউজিসি। গত ৪ নভেম্বর দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ হাজার ৫০১ জন অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে বিনা সুদে এই ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইউজিসি।

৮২ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য

সারা দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় প্রায় ৮২ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য রেখেই চলতি বছর শেষ করতে যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসি)। মামলা জটিলতার কারণে শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় চক্রের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারছে না বলে জানায় এনটিআরসিএ। এদিকে এক বছরে এনটিআরসিএতে দুইজন চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হওয়া এবং দুইজন নতুন চেয়ারম্যানের যোগদানের বিষয়টিও আলোচনার জন্ম দেয়।

প্রাথমিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

চলতি বছর শিক্ষায় সুখবর বলতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহাকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ। দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর গত ১৯ অক্টোবর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। ইতোমধ্যেই আবেদন শেষ হয়েছে। এতে সাড়ে ৩২ হাজার পদের বিপরীতে প্রায় ১৪ লাখ প্রার্থী আবেদন করেছেন।

হল খোলার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন

দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দেয়। তবে পরীক্ষার সময়ও হল বন্ধ রাখায় শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। হল খুলে পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানবন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। তবে হল বন্ধ রেখেই ঢাবি, বাকৃবি, জবিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাি ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।