স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী কাল
বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ব্র্যাক’-এর প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আগামীকাল রোববার। গতবছর ২০ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠাতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বড় পরিসরে কোনো আয়োজন থাকছে না বলে জানিয়েছে ব্র্যাক। স্যার আবেদের জীবন চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অনলাইনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
আজ শনিবার ব্র্যাকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংস্থার সব কর্মী স্মৃতিচারণের পাশাপাশি তার চিরন্তন অনুপ্রেরণার কথা স্মরণ করছেন।
১৯৫২ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে না পড়ে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান। তখন তাঁর ছোট চাচা সায়ীদুল হাসান ছিলেন লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাণিজ্যসচিব। তিনি আবেদকে স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হতে বলেন। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে এসব তথ্য দেওয়া হয়।
১৯৫৪ সালে আবেদ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। কিন্তু দুই বছর লেখাপড়া করার পরে তিনি এ বিষয়ে পড়া বাদ দিয়ে লন্ডনে গিয়ে অ্যাকাউন্টিংয়ে ভর্তি হন। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে লেখাপড়া করার সময়েই, ১৯৫৮ সালে তাঁর মা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৬২ সালে ‘কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং’ নিয়ে তিনি প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন ।
কর্মজীবনের শুরু
শিক্ষাজীবন শেষে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লন্ডন, কানাডা ও আমেরিকায় চাকরি করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। তখন গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। প্রতিদিনই মিছিল মিটিং চলছে। এক পর্যায়ে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। শুরু হয় ঊনসত্তরের গণআন্দোলন।
১৯৭০ সালে আবেদ শেল অয়েল কোম্পানির চট্টগ্রাম অফিসে যোগ দেন। এরপর পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। শেল অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা এই তিনটি দ্বীপের লাখ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারান।
ফজলে হাসান আবেদ, তাঁর বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, সহকর্মী কায়সার জামান, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আকবর কবীর এবং নটরডেম কলেজের শিক্ষক ফাদার টিম মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন ত্রাণ বিতরণ করতে তাঁরা মনপুরায় যাবেন। এসময় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে মনপুরা দ্বীপের বিপন্ন ও বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সর্বস্ব এবং স্বজন হারানো মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা বিধ্বস্ত ঘরবাড়িও তৈরি করে দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ গঠন
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্যার ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানির উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইসলামাবাদ ও কাবুল হয়ে লন্ডনে চলে যান। ১৯৭১ সালের মে মাসে লন্ডনে গিয়ে সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সম্পৃক্ত হন স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটো সংগঠন।
‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন আদায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত কার্যকলাপ বন্ধে ইউরোপীয় দেশসমূহের সরকারকে সক্রিয় করে তোলা।
‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, প্রচারপত্র বিলি, টাইমস অব লন্ডনে লেখা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা, রেডিও ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া, ইউরোপীয় দেশসমূহের পার্লামেন্ট সদস্যদের আলোচনার মাধ্যমে স্বদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবিধ কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা। পথনাটক, তহবিল সংগ্রহসহ নানা ধরনের কাজেও তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন।
‘ব্র্যাক’ প্রতিষ্ঠা
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ফজলে হাসান আবেদ সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফেরার সময় তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাটটি ৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
এক কোটি শরণার্থী, যাঁরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা তখন দেশে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। আবেদ ভারতপ্রত্যাগত শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সিলেটের সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই অঞ্চলকে তিনি তাঁর কর্মএলাকা হিসেবে বেছে নেন।
১৯৭২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন থেকেই বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি সংক্ষেপে ‘ব্র্যাক’-এর শাল্লা প্রকল্পের প্রথম পর্বের সূচনা হয়। এটিই ব্র্যাকের আনুষ্ঠানিক জন্মদিন।
দায়িত্বপালন ও অবসর গ্রহণ
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক ব্যাংকেরও প্রতিষ্ঠাতা।
২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তিনি ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল এবং ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ২০১৯ সালের ১লা আগস্ট ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং চেয়ার এমেরিটাস হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ২৪শে জুলাই ২০১৯ তারিখে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। স্যার ফজলে ২৬শে আগস্ট ২০১৯ তারিখে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।