১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৫৪

সারাক্ষণ মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলাই যার কাজ

শাহজাহান মিয়া  © ফাইল ফটো

একাত্তরের রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া। যার বয়স একাত্তর বছর। এই বৃদ্ধ বয়সেও থেমে নেই তিনি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। তার কাছে যিনিই যান, তাকেই শোনান মুক্তিযুদ্ধের গল্প। যুদ্ধদিনের নানা অজানা কাহিনী। আর এতেই আত্মতৃপ্তি খুঁজে পান তিনি।

নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার চিরাং বাজার এলাকার ‘মুক্তি ভবন’ গেলে দেখা হবে বীরোচিত এই পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে। জীবনের শেষ সময়ে এসে স্ত্রী, সন্তান ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে এখানেই বসবাস করছেন। মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া জানান, তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১ জুলাই কেন্দুয়া উপজেলার চিরাং ইউনিয়নের বাট্টা গ্রামে। বাবা সৈরত আলী ও মাতা আমেনা আক্তার খাতুনের তিন ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে বড় সন্তান শাহজাহান মিয়া। ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি কনস্টেবল পদে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা তুলতেই তিনি বলতে শুরু করেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানিদের প্রথম আক্রমণের কথা।তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ওয়্যারলেস অপারেটরের দায়িত্বে ছিলাম।

রাজারবাগে পাকসেনাদের আক্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহজাহান মিয়া বলেন, তাদের আক্রমণের বিষয়ে আমরা আগে থেকেই কিছুটা অনুমান করেছিলাম। ২৫ মার্চ রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এরই মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। আমি ওই সময় তাৎক্ষণিকভাবে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিভাগ ও জেলা শহরের পুলিশ স্টেশনগুলোতে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ইংরেজিতে একটি বার্তা লিখে পাঠাই।

বার্তাটি ছিল- ‘বেইজ ফর অল স্টেশন্স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন অ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেল্ভস, ওভার।’ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় শাহজাহান মিয়াকে সাব-ইন্সপেক্টর পদে পদন্নোতি দেওয়া হয়।

শাহজাহান মিয়া বলেন, রাজারবাগ আক্রমণের সময় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা। এতে আমিও অংশ নিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ওই রাতে আমাকেসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এ সময় আমাদের ওপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। চার দিন পর নির্যাতনের চিহৃ শরীরে নিয়ে পাকসেনাদের নির্যাতনখানা থেকে ২৮ মার্চ বেরিয়ে আসি এবং ৩০ মার্চ আমার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিয়ে চার দিন পর পৌঁছাই।

তিনি বলেন, বাড়িতে এসে নিজের চিকিৎসা করাই এবং বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করার পর ছোট ভাই নুরুল ইসলাম নুরুকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে চলে যাই। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। এ সময় ১১নং সেক্টরের অধীনে থাকা সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছি।

অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৯ ডিসেম্বর পাকসেনা মুক্ত হয় নেত্রকোনা এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়।

এদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে তখনকার ইপিআর সদর দপ্তরে গিয়ে তাদের কাছে থাকা অস্ত্র জমা দেন জানিয়ে শাহজাহান মিয়া বলেন, ২৩ ডিসেম্বর আমি পুনরায় পুলিশের চাকরিতে যোগদান করি।

মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখায় শাহজাহান মিয়াকে সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে পদন্নোতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট থেকেও শাহজাহান মিয়াকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। নিজ এলাকায়ও তিনি পেয়েছেন বহু সম্মাননা।

কিন্তু বীরোচিত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়ার আক্ষেপ- নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করলেও অদ্যাবধি তার ভাগ্যে রাষ্ট্রীয় কোনো খেতাব জোটেনি।