দশম শ্রেণির আগে থাকছে না পাবলিক পরীক্ষা, শাখা পরিবর্তন এইচএসসিতে

পরীক্ষার্থী
পরীক্ষার্থী  © ফাইল ফটো

প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাল্টে যাচ্ছে শিক্ষাক্রম। বিষয় ও সময় কমিয়ে বইয়ে আনা হচ্ছে পরিবর্তন। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এক বছরের পরিবর্তে দুই বছর হবে। দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে, যা এখন নবম শ্রেণিতে হয়। অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে শাখা পরিবর্তন করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।

পাঠ্যবই, ছুটি, পাবলিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। নতুন সব উদ্যোগই পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন শুরু করা হবে।

এনসিটিবির রূপরেখায় বলা হয়েছে, পাঠদানের সময় ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ (শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন) ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে ‘সামষ্টিক মূল্যায়নের’ ভিত্তিতে শিক্ষার্থী পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে। আর প্রথম পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ‘দশম শ্রেণির’ পাঠ্যসূচি অনুযায়ী দশম শ্রেণিতেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় পরীক্ষা নিয়ে এমনই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা ও দেশের শিক্ষাবিদদের মতামতের আলোকে পরীক্ষা নিয়ে এই পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

২০২২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই রূপরেখার আলোকে কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন পর্যায়ক্রমে শুরু হবে। প্রথম পাবলিক পরীক্ষা (এসএসসি) অনুষ্ঠিত হবে দশম শ্রেণিতে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির আলোকেই এই পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। দশম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ থাকবে না। সবাইকে ১০টি বিষয় পড়তে হবে। এর মধ্যে পাঁচটি বিষয় এসএসসি পরীক্ষা হবে। সেগুলো হলো: বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান।

এছাড়া বাকি পাঁচটি বিষয়—জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভালো থাকা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতিতে পুরোটাই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে।

বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৩২ কার্যদিবসে এসএসসি পরীক্ষা হয়। নতুন পদ্ধতি কার্যকর হলে পাঁচ কার্যদিবসেই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে।

আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সম্মিলিত ফলের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। বর্তমানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই স্তরে ৩০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও ৭০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে।

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। এসব শ্রেণিতে কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। প্রাক প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২০২২ এবং ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হবে।

চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ নম্বরের ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৩০ শতাংশ নম্বরের। এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হবে চতুর্থ শ্রেণিতে ২০২৪ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে। এছাড়া ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ২০২২ এবং ৮ম শ্রেণিতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

তবে এই রূপরেখায় পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণি শেষে জেএসসি পরীক্ষার কথা উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ দুটি পরীক্ষার কথা উল্লেখ নেই। সরকার এটা নির্বাহী আদেশে নিয়ে থাকে। যদি সরকার চায় তাহলে পরীক্ষা নিতে পারবে। তবে মূল্যায়নের কাঠামো এই রূপরেখা অনুযায়ী হবে। সরকার নির্বাহী আদেশে পিইসি পরীক্ষা নিতে চাইলে ৭০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং ৩০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে নিতে হবে। তারপরই চূড়ান্ত ফল হবে।

পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে রূপরেখায় বলা হয়েছে, শিক্ষাক্রমে যোগ্যতাকে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, গুণাবলি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি বিশেষত পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ মূল্যায়ন করে। তাই প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রেখে শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য অর্থাত্ শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, গুণাবলি ও মূল্যবোধ অর্জন সম্ভব হবে না। তাই পাবলিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শিখনকালীন মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন, জাতীয় দিবসে খোলা: বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি সাধারণত একদিন (শুক্রবার)। নিজেদের সিদ্ধান্তে কোনো প্রতিষ্ঠান দুইদিনও ছুটি রাখে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও দুইদিন ছুটি থাকবে। তবে, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস এবং বিজয় দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হবে। ওই দিবসগুলোতে সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হবে কিন্তু ক্লাস হবে না। বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি থাকবে সেগুলো ধারাবাহিক মূল্যায়নে যুক্ত হবে।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিদ্যমান শিক্ষাক্রম অবশ্যই যুগপযোগী করতে হবে কিন্তু আকাশকুসুম শিক্ষাক্রম করে লাভ হবে না। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের যোগ্যতা যদি অর্ধেক শিক্ষকের না থাকে, তাহলে এই পরিবর্তন করেই কি লাভ হবে? তিনি বলেন, আগের শিক্ষাক্রমের কি কি বাস্তবায়িত হয়েছে, আর কী কী হয়নি, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় মূল্যায়নকে কেবল শিক্ষার্থীর শিখন মূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন, শিখন পরিবেশের মূল্যায়ন ও সে সঙ্গে শিখনের মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

আসছে নতুন বই
এনসিটিবির সূত্রমতে, প্রথম বছর (২০২২) প্রাক- প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি, প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি বই পাবে। এর পরের বছর (২০২৩) অষ্টম শ্রেণি এবং ২০২৪ সালে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেওয়া হবে। ২০২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকের বই দেওয়ার কথা।

বিদ্যমান ও নতুন শিক্ষাক্রমের পার্থক্য কী?
এনসিটিবি সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়, একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমদ্বিতভাবে অর্জিত হলে তার যোগ্যতা গড়ে ওঠে। বিষয়টিকে উদাহরণ দিয়ে এনসিটিবি বলেছে, একজন শিক্ষার্থী একটি গাড়ি কীভাবে চালাতে হয়, তা যখন বই পড়ে বা শুনে বা দেখে জানতে পারে, তখন তার জ্ঞান অর্জিত হয়। ওই শিক্ষার্থী যদি গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্র হাতে-কলমে পরিচালনা করতে শেখে, অর্থাৎ সামনে, পেছনে, ডানে-বায়ে চালাতে পারে, ব্রেক করতে পারে, তখন তার দক্ষতা তৈরি হয়। আর যদি ওই শিক্ষার্থী গাড়ি চালিয়ে নিজের ও রাস্তার সব মানুষ, প্রাণী ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করে, তখন তার গাড়ি চালনার বিষয়ে যোগ্যতা অর্জিত হয়।

এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমান শিক্ষাক্রম মূলত উদ্দেশ্যভিত্তিক। এখানে পরীক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে৷ নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাক্রমে পরিবর্তনকে ইতিবাচক দেখছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, এটি জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হচ্ছে। তবে চ্যালেঞ্জ হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিয়ে। এ জন্য শিক্ষকদের আরও যোগ্য করে তুলতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ