শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষায় না রাখার ভয় দেখাচ্ছে স্কুলগুলো
বছরের শেষ সময়ে টিউশন ফি নিয়ে অভিভাবকদের চাপ দিচ্ছে রাজধানীর নামি-দামি স্কুল কর্তৃপক্ষ। এসএমএস ও নোটিশের পাশাপাশি শ্রেণি শিক্ষকরা অভিভাবকদের বারবার ফোন দিচ্ছেন। এমনকি টিউশন ফি পরিশোধ না করলে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষায় না রাখার ভয় দেখানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ অভিভাবকদের। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে উচ্চ টিউশন ফি হওয়ায় তা পরিশোধে সমস্যায় পড়েছেন তারা।
রাজধানীর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মাস্টারমাইন্ড গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসের বেতন অর্ধেক মওকুফ করে। তখন বাহবা কুড়ালেও এখন আবার টিউশন ফি পরিশোধে অভিভাবকদের প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। এমনকি বকেয়া পরিশোধ করা না হলে স্কুল থেকে নাম কেটে দেওয়ারও হুমকি দিচ্ছে তারা।
মাস্টারমাইন্ড স্কুলের অভিভাবক শর্মি ইব্রাহিম বলেন, গত ১৪ সেপ্টেম্বর পাঠানো চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব পাওনা পরিশোধের কথা বলেছে। পরিশোধ না করলে রেজিস্টার থেকে নাম কেটে দেবে বলেও বলা হয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ অভিভাবক দুরবস্থার মধ্যে আছেন। অন্যদিকে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানের অনেক ধরনের ব্যয়ই হচ্ছে না। তার পরও টিউশন ফি পরিশোধে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে এক প্রকার অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে।
রাজধানীর মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেও বারবার অভিভাবকদের টিউশন ফি পরিশোধে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তারা এখন অনলাইনে মাল্টিপল চয়েস কোয়েশ্চেন (এমসিকিউ) পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিচ্ছে। এর আগে তারা গত আগস্ট মাস পর্যন্ত টিউশন ফি পরিশোধে অভিভাবকদের একাধিকবার তাগাদা দিয়েছে। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট চলতি মাসে অনলাইনে পরীক্ষা নিলেও প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে সরাসরি। যারা আগস্ট মাস পর্যন্ত টিউশন ফি পরিশোধ করেনি তাদের প্রশ্ন দেওয়া হয়নি। ফলে বাধ্য হয়েই বেশির ভাগ অভিভাবক টিউশন ফি পরিশোধ করেছেন।
মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাসরিন নাহার বলেন, সব শিক্ষার্থীর টিউশন ফি আমরা পাচ্ছি না। যারা একবারে দিতে পারছে না, তাদের কিস্তিতে দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। আবার কেউ কেউ বেতন মওকুফের জন্য আবেদন করছেন, কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার গভর্নিং বডির। আমরা টিউশন ফি না নিলে স্কুল চালাতে পারব না, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারব না।’
জানা যায়, রাজধানীর নামি-দামি স্কুলগুলোতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। চলতি বছর স্কুল না খুললেও আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে তারা অনলাইনেই ছোট পরিসরে পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন যেহেতু বছর শেষের দিকে চলে এসেছে, তাই এর আগেই সব টিউশন ফি আদায়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেকটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
তবে যেসব অভিভাবক করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে টিউশন ফি পরিশোধ করেননি, তাঁরা এখন মহাবিপদে পড়েছেন। একবারে তাঁদের প্রায় পুরো বছরের টিউশন ফির জন্যই চাপ দেওয়া হচ্ছে। অনেক অভিভাবক যাঁরা সম্প্রতি গ্রামের বাড়ি থেকে রাজধানীতে ফিরে স্কুলে যোগাযোগ করছেন তাঁদেরও টিউশন ফি পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে। আবার যাঁরা একবারে গ্রামে চলে গেছেন, তাঁরা স্কুলে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট (টিসি) চাইতে গেলেও তাঁদের পুরো টিউশন ফি পরিশোধ ছাড়া তা দেওয়া হচ্ছে না।
অভিভাবকরা বলছেন, করোনাকালে বেশির ভাগ স্কুলই মে-জুন মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে। প্রতিদিন দুটি ক্লাসের বেশি নেওয়া হয় না। আবার অনেক স্কুল সপ্তাহে মাত্র তিন দিন ক্লাস নেয়। এই সময়ে শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনের বাইরে স্কুলগুলোর কোনো খরচ নেই। বিদ্যুৎ, পানির বিলসহ অস্থায়ী যেসব খরচ ছিল সেগুলো হচ্ছে না। এরপর টিউশন ফিতে কোনো ধরনের ছাড় দিচ্ছে না স্কুলগুলো।
তবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে এক আদেশে টিউশন ফি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন আদায় করতে বলা হয়, কিন্তু স্কুলগুলো এই নির্দেশনা আমলেই নিচ্ছে না। অনেক স্কুলের ফান্ডে কোটি কোটি টাকা থাকার পরও তারা কোনো ধরনের ছাড় দিচ্ছে না।
আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও করোনাকালে টিউশন ফি নিয়ে একটি নির্দেশনা তৈরির কাজ শুরু করেছিল। প্রকৃত অসচ্ছল অভিভাবকদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায়ে যাতে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা; কিন্তু সম্প্রতি টিউশন ফি নিয়ে একটি রিট আবেদন হওয়ায় সেটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রণালয় সেই নির্দেশনা জারি করতে পারছে না বলেও জানা গেছে। তবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাঁর একাধিক বক্তৃতায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক উভয়কেই টিউশন ফির ব্যাপারে মানবিক হতে অনুরোধ করেছেন।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, করোনাকালে অনেক অভিভাবকই অসহায় জীবনযাপন করছেন। অনেকে পরিবার চালানোর সক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছেন, তাঁরা স্কুলের বেতন কিভাবে দেবেন? এ জন্যই আমরা চলতি বছরের ছয় মাসের বেতন মওকুফ বা পুরো বছরের ৫০ শতাংশ বেতন কমানোর জন্য বেশ আগেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি, কিন্তু কোনো প্রকার সাড়া পাইনি। [সূত্র: কালের কণ্ঠ]