হাসিনা-খালেদার মুক্তির জন্য বুশের সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন প্রণব
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আজ সোমবার (৩১ আগস্ট) দেশটির রাজধানী দিল্লির সেনা হাসপাতালে মারা গেছেন। বেশ কয়েকদিন থেকে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৭১ সাল থেকেই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন প্রণব মুখার্জি। তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে কলকাতা থেকে টাকা সংগ্রহ করতেন। সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে সাহায্য নিয়ে শরণার্থীদের জন্য বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠাতেন।
বাংলাদেশকে প্রবাসী সরকারকে ভারতের সমর্থন দানের জন্য ১৯৭১ সালের ১৫ জুন ভারতের রাজ্যসভায় প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তিনি। তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ এ একটি পুরো অধ্যায় লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ: দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে।
এখানে প্রণব মুখার্জি পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের প্রতি শোষণ ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে কী প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল সবকিছু নিয়ে লিখেছেন।
২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রণব মুখার্জীর আত্মজীবনী ‘বাই দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ প্রকাশিত হওয়ার পর তার লেখা বই নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনার ঝড় ওঠে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কিছু সময় পরিক্রমা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার কিছু বিষয় এবং সে সময়ে আটক হয়ে বিশেষ কারাগারে থাকা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে তিনি ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে তার বইটিতে উল্লেখ করেছেন।
তিনি দুজনকে মুক্ত করার জন্য হস্তক্ষেপ করতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকেও অনুরোধ করেন। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে এমন আশঙ্কা ছিলো তার।
তবে শেখ হাসিনা ফিরলেও তেমনটা হবে না বলে নিজে দায়িত্ব নেন প্রণব। এরপর ২০০৯ সালের পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন মইন উ আহমেদ। প্রণব মুখার্জীর বইতে উল্লেখ আছে, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ছয় দিনের ভারত সফরে যান। এ সময় প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মইনের।
প্রণব মুখার্জী তার বইতে লিখেছেন, অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সময়, আমি তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি এই ভয় পাচ্ছিলেন যে শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাকে (জেনারেল মইন) চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিই এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তার বহাল থাকার ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করি।
আত্মজীবনীতে প্রণব মুখার্জী আরো জানান, আমি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউর বুশের অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই। তৎকালীন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে আমি সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলাম।
এর কয়েক বছর পরের ঘটনা জানিয়ে প্রণব মুখার্জী তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বেশ কয়েক বছর পর, জেনারেল মইনের যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার পথ সহজ করে দিই, তখন তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
প্রণব মুখার্জী লিখেছেন, শেখ হাসিনা আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির মাধ্যমে ভারত তার দাবি পূরণে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে।
তিনি লেখেন, শেখ হাসিনা কারাগারে থাকার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা তাকে পরিত্যাগ করলে আমি তাদের ভর্ৎসনা করে বলি, কেউ যখন এমন বিপদে থাকে, তখন তাকে ত্যাগ করা অনৈতিক। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। শেখ হাসিনা বিপুল বিজয় পান।