২৬ জুলাই ২০২০, ১৭:৩৪

টিউশন ফি’র চাপে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবকরা

  © ফাইল ফটো

চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও টিউশন ফি ও বকেয়া বেতন পরিশোধে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে অধিকাংশ ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। টিউশন ফি পরিশোধ না করায় অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। যদিও শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায়ে নমনীয়তা দেখাতে বলেছে ঢাকা শিক্ষাবোর্ড। গত ২৩ এপ্রিল এ সংক্রান্ত একটি নোটিশও জারি করেছে বোর্ড।

অভিভাবকরা বলছেন, শুধু নোটিশ নয় নয়; বিগত মাসের সব বকেয়া একসঙ্গে পরিশোধের তাগাদা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। মোবাইলে খুদে বার্তা কিংবা কল করেও টিউশন ফি পাঠানোর কথা বলছেন বারবার। এর বাইরেও অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য বাড়তি ফি নেয়ার অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তারা বলছে, ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন ফি তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। টানা চার মাস প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বেতন-ভাতার ওপর তারা নির্ভরশীল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজ গত ২২ জুলাই টিউশন ফি পরিশোধ সংক্রান্ত একটি নোটিশ দিয়েছে। এছাড়া স্কলাস্টিকা, প্লে পেন, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজসহ প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি পরিশোধে চাপ প্রয়োগ করছেন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের কাজে লাগাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে অভিভাবকদের কাছে ফোন করানোরও অভিযোগ উঠেছে। এতে করে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের ইংরেজি মাধ্যমের স্ট্যান্ডার্ড টুতে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আমাদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে টিউশন ফি পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। নিত্য নতুন পন্থা অবলম্বন করে ফি আদায়ে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ অভিভাবক অর্থসংকটে রয়েছেন। এ অবস্থায় অন্তত শিক্ষার্থীদের বেতন অর্ধেক রাখা উচিত। সেটি না করে উল্টো বেতন পরিশোধে চাপ দেওয়াটা অমানবিক।

তিনি আরও বলেন, আমার বাচ্চার টিউশন ফি ৩ হাজার টাকা। গত মার্চ মাস থেকে আমি বেতন পরিশোধ করতে পারিনি। এই অবস্থায় আমি ভর্তি বাতিল করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হলে বিগত সব বকেয়া পরিশোধ করে তবেই ভর্তি হতে হবে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে তাদের এমন সিদ্ধান্ত কোনভাবেই কাম্য নয়।

সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের আরেক অভিভাবক জানান, বিভিন্ন ভাবে আমাদেরকে টিউশন ফি পরিশোধের কথা বলা হচ্ছে। এখন বাচ্চাদের ক্লাসে যেতে হয় না। বাসায় থেকেই অনলাইনে ক্লাস করছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের উচিত টিউশন ফি কমানো। কিন্তু তারা সেটি করছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্লে পেন স্কুলের দশম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী জানান, গত ১৪ জুন থেকে আমাদের অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে টিউশন ফি পরিশোধ না করায় আমার অনেক বন্ধু ১৮ জুনের পর আর অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি।

শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায় করে দিতে শিক্ষকদের কিছু বলা হয়নি জানিয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের শিক্ষক সানজিদা রশিদ বলেন, স্কুলের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের মুঠোফোনে ফি পরিশোধের বার্তা পাঠানো হয়েছে। এটি আমাদের অফিসিয়াল পেইজেও বলা হয়েছে। অন্য প্রতিষ্ঠানের কথা বলতে পারছি না।

অভিযোগ অস্বীকার করে উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসাইন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা ফি পরিশোধের জন্য অভিভাবকদের কোনো চাপ প্রয়োগ করিনি। আমি শুধু তাদের অনুরোধ করেছি ফি পরিশোধের জন্য। চাপ দিলে তো তারিখ উল্লেখ করে দিতাম। আমরা শুধু বলেছি, আপনারা যতটুকু পারেন, যখন পারেন বেতন পরিশোধ করেন।

তিনি আরও বলেন, আমরা ভেবেছিলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের জন্য কিছু করবে। কিন্তু সেখান থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় আমরা ফি পরিশোধের কথা বলেছি। আমাদের ইলেক্ট্রিসিটি বিল দিতে হয়, শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে হয়। শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি না দিলে এইগুলো পরিশোধ করবো কীভাবে? অনুরোধকে যদি অভিভাবকরা চাপ মনে করেন তাহলে আমার আসলে কিছু বলার নেই।

করোনাভাইরাসে বিস্তার রোধে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইনে পাঠদান অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে টিউশন ফি এবং নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি ফি দেওয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত ফি পরিশোধের সুযোগ রাখাসহ টিউশন ফি’র উপর ছাড় দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা। এজন্য রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে মানববন্ধনও করেছেন অভিভাবকরা।

গত ১১ জুলাই ধানমন্ডির মাস্টারমাইন্ড-এর অভিভাবকরা ৫০ শতাংশ টিউশন ফি কমানোর দাবিতে স্কুলের সামনে মানববন্ধন করেছেন। এছাড়া মানববন্ধন করেছেন উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে দিল্লি পাবলিক স্কুলের (ডিপিএস) অভিভাবকরাও।

অভিভাবকদের টিউশন ফি পরিশোধের পক্ষে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের (এমসাব) আহবায়ক ইঞ্জিনিয়ার কাজী তাইফ সাদাত। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সবাই শুধু অভিভাবকদের চাপের কথা বলছেন অথচ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কথা ভাবছেন না। শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি না দিলে কম খরচে ভাল শিক্ষা দান করা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলে অভিভাবকরা উচ্চমানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে তাদের ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করাতে বাধ্য হবেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, পরিস্থিতি আসলে এখন উভয় সংকটে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীরা যদি বেতন না দেয় তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করতে পারবে না। অন্যদিকে করোনায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকরাও আর্থিক সংকটে পড়েছেন। সার্বিক দিক বিবেচনায় আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক আচরণ করতে বলেছি। কোন অবস্থাতেই ফি পরিশোধ করতে অভিভাবকদের চাপ দেওয়া যাবে না।