২৪ জুলাই ২০২০, ১৮:৫৬

করোনায় জীবিকা ও শিক্ষা নিয়ে চরম বিপর্যস্ত শত শত পরিবার

  © সংগৃহীত

ঘটনা-১: সুমি বেগম (৩৫)। রাজধানীর মানিকনগর এলাকার ছোট্ট একটি ঝুপড়ি ঘরে বাস দুই সন্তানের জননীর। ৫ বছর ধরে স্বামী পরিত্যক্তা। ছোট ছেলের বয়স ৮ হতেই স্বামী নিরুদ্দেশ। তার পর থেকেই শুরু সংগ্রামী অধ্যায়ের। গার্মেন্টসে চাকরি করে কোনভাবে সংসার চালালেও দুই ছেলেকে পড়ালেখা করানোর ছিল তীব্র ইচ্ছে। কিন্তু টাকার অভাবে সেটা কখনোই হয়ে উঠতো না।

স্বামী চলে যাওয়ার দুইবছর পরে বড় ছেলেকে (১৭) একটি হোটেলে চাকরি দিয়ে ওই টাকার অর্থ থেকে ছোট ছেলের (১৫) পড়া লেখার খরচে ব্যয় করা শুরু করেন। একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিল তার ছোট ছেলে। টুকটাক করে চলছিল তিনজনের সংগ্রামী জীবন।

হঠাৎ করোনার থাবায় ছিন্নভিন্ন জীবনে এখন ঘোর অমানিশা। সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ, ছেলের চাকরিও নেই, শেষ পর্যন্ত নিজের চাকরিটাও চলে গেল। তিনমাসের ঘরভাড়া সাথে বিদ্যুৎ বিল বাকি। পরিশোধ করার কোন উপায় না দেখে সামান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে সকালের আলো ফোটার আগেই রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।

দেখুন: স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্ট নিয়ে রাতের আঁধারে ঢাকা ছাড়ছে ওরা

ঘটনা-২:  মোসলেম মন্ডল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। দুইছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ৫ সদ্যসের সুখের সংসার। তিন জনই পড়ে নামকরা স্কুল-কলেজে। করোনার আঘাতে অফিসের সাথে বন্ধ হয়ে যায় জীবনের আলোও। রাজশাহীর সাহেববাজারে তিনরুমের দামী ফ্ল্যাটে সংসার পেতেছিলেন। অফিস বন্ধ থাকায় দামী ফ্ল্যাটের দাম শোধ করতে না পেরে ঘরের ভেতরে দামী দামী জিনিস রেখে তিনিও রাতের আঁধারে গ্রামের পথে পাড়ি জমিয়েছেন।

ঘটনা-৩: একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান। রাজধানীর নয়া পল্টন এলকায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে একছেলে ও একমেয়ে নিয়ে গড়েছেন সুখি পরিবার। বড় ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন আর ছোট মেয়ে সরকারি কলেজে। এজেন্সি তৈরীর বেশ কিছুদিন পর আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। আর্থিক সক্ষমতায় পূর্ণ পরিবারটি এখন চরম বিপাকে। তার সাথে মেয়ের এইচএসসি পরীক্ষা এবং ছেলের সেমিষ্টার নিয়ে ব্যাপক দুশ্চিন্তা তার।

ট্রাকভর্তি স্বপ্ন নিয়ে গ্রামের দিকে ছুটছে এক পরিবার

ঠিক এভাবেই রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো থেকে পালিয়েছেন শত শত পরিবার। কিংবা যারা আছেন তাদের কেউ কেউ বাস করছেন চরম দুর্দিনে। কেউ বা আবার বড় রুম ছেড়ে উঠেছেন ছোট টিনশেডের রুমে। এই পরিবারগুলোর জীবনের সাথে সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন ছেলেমেয়ের শিক্ষাব্যবস্থা।

শহুরে জীবনের ব্যয় মেটাতে না পেরে, চাকারি হারিয়ে অথৈই সাগরে পড়ে তারা বাধ্য হয়েছেন গ্রামে ফিরে যেতে। এতে তাদের শুধু জীবিকা যে অনিশ্চিত হয়েছে তা নয় তাদের সন্তানদের শিক্ষাজীবন, মানসিক অবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়েছে। গ্রামে চলে যাওয়া বেশিরভাগ পরিবারই পুনরায় ঢাকা আসবে কিনা সেটা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।

এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ায় নিশ্চিত একটা বছর শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে বহু শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী গ্রামের স্কুলে আবার নতুন করে ভর্তি হলে সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াও একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ।

পরিবারগুলোর জীবিকার ব্যবস্থা, সন্তানদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো একটা বড় সময়ের ব্যাপার। তার সাথে চেনা-পরিচিত গন্ডি, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে অচেনা গ্রামীণ জীবন তার সন্তানরা কতটুকু মানিয়ে নিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে পারবে সেটাও দেখার বিষয়।

এর মধ্যে এমন পরিবারও আছে যাদের সন্তানরা লেখাপড়ায় আর ফিরতে পারবে না। কেননা তাদের নির্দিষ্ট আয়-রোজগার অনিশ্চিত হয়ে গেছে। জীবনের সাথে শিক্ষা জীবনের এতবড় ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন অনেকেই ভুলে গেছেন। হতাশা আর মানসিকভাবে এখন তারা চরম বিপর্যস্ত।