বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কীভাবে?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর বিশ্বের প্রায় সব দেশে অনির্দিষ্টিকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অবশ্য কিছু দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে বাংলাদেশে কবে নাগাদ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যাবে তা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। করোনা সংক্রমণ এখনও উচ্চ থাকায় নীতি নির্ধারকরা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, কবে চালু করা যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হলেও একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কবে ভর্তি শুরু হবে, সে বিষয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেছেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তিন সপ্তাহ আগে ভর্তি কার্যক্রম অনলাইনে শুরু করে দেওয়া হবে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হবে, তা বলা সম্ভব নয়।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিকের দিকে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন পাঠ কার্যক্রমের বাইরে থাকায় তাদের ফের অভ্যস্ত করার প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি করোনা থেকে তাদেরকে পুরোপুরি সুরক্ষিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া সিলেবাস ও পরীক্ষা নিতে না পারায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৬ মার্চ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সে ছুটি আগামী ৭ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে আরও বাড়বে ছুটি। অনেকে সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবরের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা দেখছেন না। তবে যখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক, তার আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
অভিভাবক রাজু বিশ্বাস মনে করেন, করোনা সংক্রমণে তো আর কারোর হাত নেই। এতে শিক্ষায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নিতে এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করা জরুরি। তাহলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলে বেশি সমস্যায় পড়তে হবে না। শিক্ষার্থীদের এখন থেকেই বাড়ির বিভিন্ন কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখা জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষকরা অনেকেই শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে আছেন। অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন, টেলিভিশনেও ক্লাস চলছে। তবে করোনার পর ক্লাস-পরীক্ষা শুরু বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথাও ভাবতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় বিভিন্ন দেশে শিক্ষা কার্যক্রম ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। ডেনমার্কে গত ১১ মার্চ বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল খুলছে আগামী ২০ এপ্রিল। ব্রিটেনে জুন থেকে কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চলতি জুলাইয়ের শুরুতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে থাইল্যান্ডে। তবে তাদের জন্য কাঁচের বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়াল করা হয়েছে। পাশাপাশি তাপমাত্রা মাপা, হাত ধোয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে প্রতিবেশি দেশ ভারত এখনও স্কুল খোলার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সেখানে প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে। বাংলাদেশেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় আপাতত পরীক্ষা ছাড়াই পাস করিয়ে দেওয়াসহ অনলাইনে কার্যক্রম জোরদার করার মতো নানা বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে করোনার ঝুঁকি কমাতে মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার, হাত ধোয়া কিংবা তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেজন্য বড় পরিসরে প্রস্তুতি নিতে হবে আগে থেকেই। শ্রেণিকক্ষে কীভাবে বসবে তা ঠিক করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের শ্রেণিকক্ষ সংকট বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন সমস্যা সমাধানে জার্মানি, ইংল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশে আলাদা শিফট করে শ্রেণি কার্যক্রম চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের পরস্পরের সরাসরি যোগাযোগ কার্যক্রম বন্ধ রাখা দরকার। যেমন অ্যাসেম্বলি, টিফিনের মতো সময় রয়েছে। বিদ্যালয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময়ের বিষয়টিও ভাবতে হবে। গণপরিবহন ব্যবহারের ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার মতো শহরে এ ধরনের সমস্যা প্রকট। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে করণীয় কি? সিলেবাস, পরীক্ষা, পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ কীভাবে শেষ হবে, সে ব্যাপারে বৃহৎ পরিকল্পনা নিতে হবে। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টিও আমলে নিতে হবে।
তবে বিষয়টি নিয়ে সরকার ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানালেন জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমীর (নেপ) শিক্ষা গবেষক মুহাম্মদ সালাউদ্দিন। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, করোনা পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য সরকার ইতিমধ্যে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। আগে থেকেই সব ঠিক করে রাখা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেই সরকার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে দেবে।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকরাও তাদের দায়িত্ব তখন বুঝতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক তারা সিলেবাসসহ সার্বিক কার্যক্রম শেষ করবেন। এছাড়া টেলিভিশনে ক্লাস, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তদারকির মতো বিষয়গুলো তো রয়েছেই।
বেসরকারি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ফয়সাল আকবর বলেন, করোনার পর শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে প্রথমত শুধু বার্ষিক পরীক্ষার কথা ভাবতে হবে। সেক্ষেত্রে সিলেবাসটা সংক্ষিপ্ত করার বিকল্প নেই। এছাড়া প্রয়োজনে বিষয় কমিয়ে হলেও পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আর শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করতে হলে এখন থেকেই বিভিন্ন ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট বা হোমওয়ার্ক দিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখতে হবে। সর্বশেষ, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এসব বিষয়ে নিয়ে সরকারও নানা পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানিয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘মনে হয়, একাদশে খুব শিগগিরই ভর্তি শুরু করতে পারবো। করোনার মধ্যেই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল দিতে পারলাম। এখন তাদের কলেজে ভর্তির বিষয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। কিন্তু ভর্তি অনলাইনে করা যায়, তাই শিগগিরই ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবো।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘করোনার কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষ আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়তে পারে। পাশাপাশি শ্রেণিঘন্টার সঙ্গে সমন্বয় করে কমানো হতে পারে মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণির সিলেবাস। এমন পদক্ষেপের কারণে আগামী বছরে ঐচ্ছিক ছুটি কমিয়ে আনা হতে পারে। যেসব পরীক্ষা এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি সেগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনা যায় কিনা তাও ভাবছি।’ সংশ্নিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।