বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবি: চোখের সামনে মা বোনকে হারালাম
মুক্তা, তোদের সাথে তো আমিও ছিলাম। মাকে নিয়ে চলে গেলি বোন! তোকে আমি কত ভালোবাসি জানিস না! পানির মধ্যে আমি অনেক খুঁজেছি তোকে, মাকে। পাইনি। চোখের নিমেষেই তোরা ডুবে মারা গেলি, আমি কেন বেঁচে ফিরলাম!'
রোববার(২৯ জুন) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ চত্বরে এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে বেঁচে ফেরা তরুণ সাইফুল ইসলাম রিফাত।
মা ময়না বেগম (৪৩) ও ছোট বোন মাহমুদা আক্তার মুক্তাকে নিয়ে 'মর্নিং বার্ড' লঞ্চে ঢাকায় ফিরছিলেন রিফাত। সঙ্গে রিফাতের এক বন্ধুও ছিলেন, ইরফান। রিফাত ও ইরফান ডুবন্ত লঞ্চ থেকে বেঁচে ফিরে আসেন। কিন্তু ফিরতে পারেননি রিফাতের মা আর বোন।
লঞ্চডুবি থেকে বেঁচে ফেরা রিফাত পুরান ঢাকার চকবাজারে একটি অনলাইন শপিংয়ে ডেলিভারিম্যান হিসেবে চাকরি করেন। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মিল্ক্কিপাড়ায়। তারা দুই বোন ও এক ভাই। পাঁচ বছর ধরে সোয়ারিঘাট এলাকায় বসবাস করেন তিনি। বছরখানেক আগে ছোট বোন মাহমুদা আক্তার মুক্তা ও মা ময়না বেগমকে নিয়ে আসেন ঢাকার ভাড়া বাসায়। মাঝেমধ্যেই মা ও বোনকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যেতেন।
গত শুক্রবার কর্মস্থল থেকে তিন দিন ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন রিফাত। সঙ্গে ছিলেন মা ও বোন। ছুটি শেষ করে সোমবার চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল রিফাতের। এজন্য সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে মুন্সীগঞ্জ কাঠপট্টি থেকে 'মর্নিং বার্ড' লঞ্চে ওঠেন মা ও বোনকে নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু ইরফান। মাঝপথে এসে ইরফান দোতলা লঞ্চের ছাদে উঠে যান। মা-বোনের সঙ্গে দোতলায় পাশাপাশি বসেছিলেন রিফাত। সারাপথ বোনের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে আসেন তিনি। সদরঘাটের কাছাকাছি এসে চোখের নিমেষেই তাদের বহনকারী লঞ্চটি ডুবে যায়।
রিফাত ও তার বন্ধু ইরফান বেঁচে ফিরলেও রিফাতের ডান পায়ের হাঁটু কেটে গেছে ডুবন্ত লঞ্চ থেকে বের হওয়ার সময়। উদ্ধারকারী দল রিফাতকে পুরান ঢাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ছুটে যান তিনি। কারণ, বুড়িগঙ্গা থেকে লাশ উদ্ধারের পর নেওয়া হয় ওই মর্গে। রিফাতের বড় বোন মুন্নি আক্তারসহ আত্মীয়-স্বজনরাও ছুটে আসেন মর্গে। সাদা কফিনে সারিবদ্ধভাবে রাখা লাশের মধ্যে মা ও বোনের মৃতদেহ খোঁজেন স্বজনরা। পায়ে আঘাতের কারণে মর্গ চত্বরে বসে আহাজারি করছিলেন রিফাত এবং মুন্নি আক্তার।
মুন্নি ও রিফাতের বুকফাটা কান্নায় কেউই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। একই সঙ্গে বোন ও মা-হারা দুই ভাইবোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেন স্বজনরা। আর্তনাদ করতে করতে রিফাত বলেন, 'পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তবুও ডুবন্ত লঞ্চের মধ্যে মা-বোনকে খুঁজেছি। কিন্তু খুঁজে পাইনি। মুহূর্তেই চোখের সামনে মা-বোন ডুবে মরল! আমি কেন বেঁচে ফিরলাম।'
রিফাত জানান, কোরবানি ঈদের আগে আর গ্রামে ফিরবেন না বলেও কথা হয়েছিল তাদের মধ্যে। ঠিক করেছিলেন, একবারে কোরবানির সময় একসঙ্গে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু মা-বোনকে নিয়ে আর কখনোই গ্রামের বাড়ি ফেরা হবে না রিফাতের। এখন থেকে তাকে একাই যেতে হবে গ্রামে।
লঞ্চ দুর্ঘটনা সম্পর্কে রিফাত জানান, এটি একটি ছোট লঞ্চ। তার ধারণা, ৬০-৭০ জন যাত্রী ছিল। ৯টার দিকে সদরঘাটের কাছাকাছি ফরাশগঞ্জ বরাবর আসে। এ সময় একটি লঞ্চ ব্যাকগিয়ার করে তাদের বহনকারী লঞ্চের পেছনে সজোরে ধাক্কা মারে। চোখের নিমেষেই লঞ্চটি এক ধাক্কায় উল্টে ডুবে যায়। ভেতরে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। রিফাত বলেন, ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে আমি মা-বোনকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু এর আগেই লঞ্চ ডুবে যায়।