করোনা সঙ্কট: রাজধানীবাসীর পাশে তৃতীয় লিঙ্গের সমন্বয়ে ঢাবির ‘বৃহন্নলা’
- ছিদ্দিক ফারুক, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৬ মে ২০২০, ১১:৪৪ PM , আপডেট: ০৬ মে ২০২০, ১১:৪৪ PM
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে রাজধানীর ঘরবন্দি মানুষকে বিনামূল্যে জরুরি সেবা দিচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা, যাদের সংগঠিত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বৃহন্নালা’। চলমান করোনা সঙ্কটের ফলে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে গত শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শপথ পাঠের মাধ্যমে মাঠে নামে এই সামাজিক সংগঠনটি। তবে গত ২২ মার্চ থেকে সংগঠনটির সভাপতি সাদিকুল ইসলাম নিজ উদ্যোগেই কাজটি শুরু করেন
বর্তমানে এ সংগঠনটির উদ্যোগে ১০ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যসহ ১৪ সদস্যের একটি দল রাজধানীর যে কোনো প্রান্তের মানুষের প্রয়োজনে সাড়া দিচ্ছেন। বাজার করা, জরুরি ওষুধ সরবরাহ, গর্ভবতী নারীসহ অসুস্থদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, বিপন্ন মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করাসহ জরুরি সেবা দিচ্ছেন তারা।
এছাড়া সংগঠনের তহবিল থেকে অসহায় মা ও শিশুর খাদ্য যোগান এবং সঙ্কটাপন্ন মানুষকে ত্রাণসামগ্রী, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারও বিতরণ করছে এই বৃহন্নালা সংগঠন। বৃহন্নালার ফেসবুক পেজ এবং হটলাইন নাম্বারগুলোতে যোগাযোগ করলে মিলছে সহায়তা।
ব্যাপক চাহিদা ও রাজধানীর পুরো অঞ্চল একা সামালাতে না পেরে অবশেষে তৃতীয় লিঙ্গসহ সংগঠনকেও সম্পৃক্ত করেন সাদিকুল। প্রথমে তিনি সাইকেল চালিয়ে মানুষকে এসব সেবা দিতেন। এখন মানুষের সহায়তায় পিকআপ ভাড়া করে কাজ করছেন তারা।
বৃহন্নলার স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরা শাহজাদপুর বস্তি এলাকায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ; সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ি, পলাশী, আজিমপুর, চাঁনখারপুল, লালবাগ, পুরান ঢাকা, চকবাজার ঢাকা মেডিকেল এলাকায় গণপরিবহনে, ঘনবসতিপূর্ণ জেনেভা ক্যাম্প ও অ্যাম্বুলেন্স জীবাণুনাশক স্প্রে করা, মানুষকে সচেতন করা, কমলাপুর বস্তিতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণসহ নানা কাজ করেছেন।
এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। এই সংগঠনিটর প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী সাদিকুল ইসলাম সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
সাদিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের সমাজে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদেরকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়, সমাজ থেকে যাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে, তারা আজ সমাজের প্রয়োজনে, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মানবসেবায় কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করার জন্য প্রস্তুত তারা। এটাই প্রমাণ করে বৃহন্নলারাও যে আমাদের সমাজে অবিচ্ছেদ্য অংশ, তারাও মানুষ।আমরা এই মেসেজটা সমাজের মানুষকে জানান দিতে চাই।
ফান্ডিংটা কিভাবে সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রথমে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী কম ছিল। পরবর্তীতে আমরা যখন কাজ শুরু করি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ডাকসুর সংস্কৃতি সম্পাদক আসিফ তালুকদার,এবং ঢাবি বিভিন্ন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সহায়তায় ফান্ড হয়েছে।
এই কাজগুলোর মাধ্যমে হিজড়াসহ ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসবে বলে দৃঢ় আশাপ্রকাশ করে তিনি বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করাই আমাদের লক্ষ্য। হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সমাজে নেতিবাচক মনোভাব আছে।
নিজেদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে সাদিকুল বলেন, গত এক সপ্তাহে আমরা আড়াইশ’রও অধিক পরিবারকে জরুরি সেবা প্রদান করতে পেরেছি, যা চলমান থাকবে এবং শুরু থেকে হিসাব করলে ৫০০ এর অধিক হবে বলে মনে করি।
কল পাওয়ামাত্রই বাজার নিয়ে সাহায্যপ্রার্থীর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছেন আমাদের টিমের হিজড়া সদস্যরা। কিনে দিচ্ছেন তার প্রয়োজনীয় জিনিস। সেই সাথে গর্ভবতী নারী ও অসুস্থ শিশুদের দ্রুত হাসপাতালে বিনা খরচে পৌঁছে দিচ্ছি আমরা-যোগ করেন সাদিকুল।
এতবড় এরিয়া কিভাবে সামাল দিচ্ছেন? জানতে চাইলে সাদিকুল জানান, মনে করেন আমি উত্তরায় আছি এই মুহুূর্তে চাঁনখার পুলের একজনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তখন সেই এরিয়ায় আমাদের যে হিজড়া স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে তার মাধ্যমে আমরা পৌঁছে দিচ্ছে। তার বিকাশে টাকা পাঠায় এবং তিনি বাজারসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সাহায্যপ্রার্থীর বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন।
তিনি জানান, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশ, বেসরকারি সংগঠন উত্তরণ ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই দাঁড়ানো আমাদেরকে আরো নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে।
জরুরি সেবা পেতে ০১৯৮০৭০৪৩৯৬, ০১৭৩৫৮৯৩১০২, ০১৭৮১৫৫৩৫২৮ নম্বরে কল করতে হবে। বিনিময়ে তারা কোনো সার্ভিস চার্জ বা খরচ নিচ্ছেন না। বৃহন্নলার নিয়মিত স্পন্সরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এসব কাজে অর্থ যোগানে সহায়তা করছেন।