চোখের সামনেই তিলে তিলে মানুষকে মরতে দেখেছি
শামসু আলম। বয়স ১৮। ৫৩ দিন ধরে তিনি সাগরে ভাসছিলেন। মাছ ধরার ট্রলারটিতে তার সঙ্গে এমন আরও অনেক শরণার্থী ছিলেন। চোখের সামনে বন্ধুদের ক্ষুধায় মরতে দেখেছেন। তিনি নিজে শুধু সাগরের পানি পান করে বেঁচে ছিলেন।
কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রলারের ডেকের নিচে নিকষ অন্ধকারে, কিংবা চারপাশে পানির মধ্যে বসে কাটিয়েছেন এই রোহিঙ্গা। এই গভীর সমুদ্রে প্রার্থনা করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাদের। দুই সপ্তাহ আগে শামসু আলম সহ এমন বহু রোহিঙ্গাকে বহনকারী ট্রলারকে তীরে নিয়ে আসা হয়।
ওই সময় তিনি প্রায় অর্ধমৃত। সেই সময়কার কথা স্মরণ করেই শামসু বললেন, “আমি যেন লাশের মতো পড়ে ছিলাম। আমি জীবিত ছিলাম, কিন্তু কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না। ধন্যবাদ আল্লাহকে যে আমার প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু আমার চোখের সামনেই তিলে তিলে বহু মানুষকে মরতে দেখেছি।”
১৬ই এপ্রিল মালয়েশিয়া ভিড়তে ব্যর্থ হয়ে সাগরে ভাসতে থাকা ওই নৌকা উদ্ধার করা হয়। সেখানে জীবিত পাওয়া যায় প্রায় ৩৯০ জনকে। কক্সবাজারে অবস্থিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির কুতুপালং-এর ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পালাচ্ছিলেন তারা। তাদের নিজ দেশ পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে জাতিগত নিধনাভিযান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
উদ্ধার হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে তারা সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিলেন মালয়েশিয়ায়। কিন্তু করোনাভাইরাস লকডাউনের কারণ দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের নামতে দেয়নি। তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে তারা ফিরে এলেন বাংলাদেশের শিবিরেই। এখানেই তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।
জাতিসংঘ সতর্কতা জারি করে বলেছে, বঙ্গোপসাগরে এমন আরও অনেক নৌকা ভাসছে। এদের উদ্ধারে সহায়তা না করা হলে “ভয়ঙ্কর মাত্রার মানবিক বিপর্যয়” দেখা দিতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে যে, কমপক্ষে ৭০০ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু বর্তমানে খোলা সমুদ্রে ৩ সপ্তাহ ধরে ভাসছে। তীরে ফেরার কোনো আশা তাদের নেই বললেই চলে। নেই জরুরি স্বাস্থ্য সহায়তা, খাদ্য কিংবা পানি।
শামসু জানান, এসব নৌকার পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয় পুরুষদের জড়ো করে রাখা হয় ডেকে। নারী ও শিশুদের আশ্রয় হয় ডেকের ওপরে। কিন্তু প্রত্যেকের মাঝেই খাবার নিয়ে আহাজারি। দিন ভালো হলে আধা কাপ সুপেয় পানি পাওয়া যায়। বিকেলের দিকে একমুঠো চাল জুটে। পাচারকারীরা অনেক শরণার্থীকে পিটিয়েছে।
শামসু যে নৌকায় ছিলেন, সেখানেই কমপক্ষে ৭০ জন মারা গেছে। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য দাতব্য সংস্থা ডক্টর্স উইদাউট দ্য বর্ডার্স, যারা উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিয়েছে, তারা জানিয়েছে, বেশিরভাগ শরণার্থীই দাঁড়াতে বা হাঁটতে সক্ষম ছিলেন না। তাদেরকে উদ্ধার করেছে বাংলাদেশের কোস্টগার্ড।
সাগরে এখনও ভাসছে যেসব নৌকা সেখানকার যাত্রীদেরও একই দশা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রায় ১৫ দিন আগে ২০০ জন যাত্রী সহ একটি নৌকাকে কিছু খাবার দিয়ে মালয়েশিয়ার সমুদ্র সীমা থেকে বের করে দেওয়া হয়। ওই নৌকার অবস্থা জানা যায়নি। শনিবার ৫০ যাত্রী সহ একটি ছোট নৌকাও ফিরে এসেছে বাংলাদেশে।
দেশটির কর্তৃপক্ষ বলছে না যে, এদের কি বড় কোনো নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কিনা। তবে সাব্বির আহমেদ (৪৮) নামে এক রোহিঙ্গা জানান, তার দুই মেয়ে ইমতিয়াজ বেগম ও শওকত আরা বেগম দুই মাস আগে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে শিবির থেকে রওনা দেয়। শনিবার তারা ফোন দিয়ে জানায় যে, তারা বেঁচে আছে, আর বাংলাদেশেই আছে। এরপর থেকে তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তিনি এ-ও জানেন না, এদেরকে কোথাও পাঠানো হবে। তবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গাদের ভাষানচর নামে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে পাঠানো হবে। ওই দ্বীপে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র বানানো হয়। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ওই দ্বীপ বসবাসযোগ্য কিনা তা স্পষ্ট নয়।
সাব্বির আহমেদ জানান, তিনি শনিবারের ওই ফোনের আগে ৪১ দিন ধরে তার মেয়েদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। তিনি আশঙ্কা করেন যে তার মেয়েরা হয়তো মারা গেছে। এই ৩ দিন আগে পাচারকারীরা তাকে জানিয়েছে যে, মূল টাকার সাথে যদি আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হলে, মেয়েদের জীবিত ফেরত পাবেন তিনি।
গত সোমবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন সংবাদ মাধ্যমকে জানান যে, তার দেশ আর রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে না। তিনি বলেন, “আমি আর এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দানের বিরোধী, কেননা বাংলাদেশকেই সবসময় অন্য দেশের দায়িত্ব নিতে বলা হয়।” কিন্তু শনিবার এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া দেশটির পলিসির পরিবর্তন কিনা, তা জানা যায়নি।
মালয়েশিয়াও জানিয়েছে, তারা আর কোনো শরণার্থী নেবে না। দেশটি এই সপ্তাহান্তে কুয়ালালামপুরে ৫০০ অনথিভুক্ত অভিবাসীকে আটক করেছে। এক্ষেত্রেও করোনাভাইরাসের বিস্তারকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে দেশটি।
সাব্বির আহমেদ বলেন, তিনি তার মেয়েকে শিবির ছেড়ে যেতে দিয়েছেন কারণ তিনি আশঙ্কা করছিলেন শিবিরে বেশিদিন থাকলে মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। অপরদিকে শামসু আলম জানান, ৪০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি শিবির ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলেন, কারণ কুতুপালং-এ তার নিজেকে ‘খাঁচার ভেতরে থাকা পাখি’র মতো মনে হয়েছিল। কাজও করতে পারছিলেন না, বের হওয়া যাচ্ছিল না। অন্যান্য অনেকে, বিশেষ করে স্বামীহারা অনেক নারী মালয়েশিয়ায় ইতিমধ্যেই আশ্রয় নেওয়া আত্মীয়স্বজনের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। অনেকে অবশ্য তীব্র ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবিরটিতে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি সম্পর্কে গুজব শুনে পালাতে চেয়েছিলেন। সেখানে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি শিবিরের চারপাশে বেড়া স্থাপন করা হয়েছে। এসব বিষয়ও বাসিন্দাদের কারও কারও মাঝে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
রহিম উল্লাহ নামে এক শরণার্থী জানান, তার ১৬ বছর বয়সী ছোট ভাই ফরিদ ১৯শে মার্চ শিবির ছেড়েছে। রহিম বলেন, ফরিদ শিবিরে সুখী ছিল না। সে ছিল পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য।
তিনি বলেন, “এরপর থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। আমি সম্প্রতি এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ভিডিওতে দেখেছি সাগরে ভেসে থাকতে। আমি তাকে চিনতে পেরেছি কারণ শিবির ছাড়ার সময়ও একই পোশাক পরে সে বের হয়েছিল।”
রহিম উল্লাহ ও তার পরিবার এখন তাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট এই সদস্যের খবর জানতে উদগ্রিব। একই পরিস্থিতি পার করছে আরও হাজার হাজার পরিবার। আন্তর্জাতিকভাবেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এই সংকট ২০১৫ সালের সংকটেরই পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হামাদি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে কতদিন তাদের থাকতে হবে সেই নিশ্চয়তা নেই। এই অঞ্চলের দেশগুলো যদি অনতিবিলম্বে একে অপরের জন্য অপেক্ষা না করে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, তাহলে অদৃশ্য সলীল সমাধির জন্য তারাই দায়ী থাকবে।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট গত সপ্তাহে বাংলাদেশকে চিঠি লিখে বন্দর খুলে দিয়ে এই নৌকাগুলোকে অবতরণের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোকেও তিনি চিঠি লিখেছেন।
এই পরিস্থিতিতে রহিম উল্লাহ ও তার পিতামাতার প্রার্থনা করা ছাড়া কিছুই করার নেই। রহিম বলেন, “আমার পিতামাতা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন যেন সে (ফরিদ) নিরাপদে থাকে। ছেলের কথা ভেবে তারাও কিছু খাচ্ছেন না। সে তো পরিবারের সবচেয়ে ছোট।” (সূত্র: মানবজমিন)