দুটো মেয়ে নিয়ে আমি এখন কী করব? প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চান মাজেদের স্ত্রী
প্রায় এক দশক আগে ৮ এপ্রিল ৪০ বছর বয়সী বিধবা জরিনাকে বিয়ে করেছিলেন ৭৩ বছর বয়সী স্বামী আলী আহমেদ। চলতি বছর ছিল তাদের দশম বিবাহবার্ষিকী। তার একদিন আগেই ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের মিরপুরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদকে। প্রকৃতপক্ষে খুনি আবদুল মাজেদ পরিচয় লুকিয়ে আলী আহমেদ নামে কলকাতায় বসবাস করছিলেন। ১২ এপ্রিল তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে বাংলাদেশ সরকার। কলকাতা থেকে লিখেছেন- কৃষ্ণকুমার দাস
স্বামীর আচমকা ফাঁসি হওয়ায় বিন্দুমাত্র দুঃখ পাননি বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুল মাজেদের স্ত্রী জারিনা বেগম। বরং এক রাষ্ট্রনায়কের খুনিকে বিয়ে-সংসার করতে হয়েছে ভেবেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। তার ও ৬ বছরের মেয়ের সঙ্গে প্রতারণা করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি মাজেদের ফাঁসি হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন জারিনা। তিনি বলছেন, ‘অত বড় একজন মানুষকে যে খুন করে আসতে পারে, সে তো আমার মতো একটা গরিব গ্রামের মেয়েকে সহজেই ধোঁকা দিতে পারে। উনার আরও কঠিন কিছু শাস্তি হলে হয়তো আরও ভালো হতো।’
জারিনা বেগম, বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুল মাজেদের দ্বিতীয় স্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বাগনানের কিমসত বামন গ্রামে বাপের বাড়িতে এখন কার্যত শয্যাশায়ী। জারিনার এর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, সেই পক্ষে একমাত্র কন্যা সন্তান এবার দ্বাদশ শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। মাজেদের ঔরসে মেয়েটি ৬ বছরের। ফাঁসির ৩ সপ্তাহ পরেও সেই ছোট মেয়ে আর নিজে একসঙ্গে কেঁদে চলেছেন।
শনিবার বাগনানের বাড়িতে বসে মাজেদকে ‘ধোঁকাবাজ’ আখ্যা দিয়ে জারিনা উল্টে একগাদা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। জিজ্ঞাসার সুরে বললেন, ‘এক বিছানায় ৯ বছর ঘুমালাম, একসঙ্গে নমাজ-রোজা করলাম, সন্তান হল, সংসার করলাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না। জানতে পারলাম না, কোন চক্রে যুক্ত ছিলেন। কাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন, তাও বুঝতে পারলাম না? টের পেলাম না, এত বড় অপরাধী এমন সুন্দর ছদ্মবেশে আমায় নিয়ে এত সুন্দর অভিনয় করে গেল?’
প্রায় ১৯ বছর ধরে কলকাতায় আত্মগোপন করে থাকলেও জারিনার সঙ্গে পরিচয় ৯ বছর আগে। বাগনানে একটা হাক্কানি মসজিদে জামাতের সঙ্গে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন। পরিচয় দেন আহমেদ আলি, ইংরেজির গৃহশিক্ষকতা করেন বলে। সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র ছিলেন, থাকেন পার্কস্ট্রিটে। প্রথম পক্ষের স্বামী মারা যাওয়ায় বয়সে অনেকটা বড় হওয়া সত্ত্বেও বিধবা মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান জারিনার বাবা। ‘তখন যদি জানতাম এত বড় একজন দেশনেতার খুনি তা হলে কী বিয়ে করতাম?’ বলেন জারিনা।
জন্মের পর মেয়ের নাম সৈয়দ আয়েশা সিদ্দিকা হুমায়ারা রেখেছিলেন স্বয়ং মাজেদ। বাংলাদেশেও দুই মেয়ে ফাতেমা ও মাসুমা সিদ্দিকার নামকরণ মাজেদেরই করা। আয়েশা এখনও মাঝে মধ্যেই ‘আব্বা কখন ফিরবে’ বলে জারিনাকে প্রশ্ন করছে। কিন্তু সন্তানকে সত্যি ঘটনা বলতে পারছেন না অসহায় মা। জারিনার প্রশ্ন, ‘ওকে কোনো দিন কী বলতে পারব, ওর বাবা একজন খুনি হওয়ায় ফাঁসি হয়ে গেছে? ও যখন স্কুলে যাবে তখন যদি সহপাঠীরা জানতে পারে, কি করে ক্লাস করবে বলুন তো?’
এক টাকা রোজগার নেই, তাই নিজের ও দুই সন্তানের জন্য দুই বাংলার দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও মমতা ব্যানার্জির কাছে সাহায্যের আর্তি জানিয়েছেন কপর্দকশূন্য জারিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যার উদ্দেশে তার আবেদন, ‘আমায় ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করেছেন এক বাংলাদেশি। কিন্তু শরিয়ত মেনেই তো আমি তার স্ত্রী। আইন মেনে তার শাস্তি হয়েছে। কিন্তু দুটো মেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে আমি কী করব? একজন মা হয়ে আমার সংকট, যন্ত্রণা নিশ্চয়ই আপনি বুঝবেন?’
মাজেদ নিজে কখনও বাড়ি থেকে খুব একটা মোবাইলে ফোন করতেন না বলে জারিনা জানিয়েছেন। ফোন এলে এক-দুটো কথা বলে কেটে দিতেন। জানতে চাইলে উল্টো ধমক দিতেন। বলতেন, এত জানার দরকার কী? যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, মাঝে-মধ্যেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে আত্মীয়পরিজনকে ফোন করতেন মাজেদ। বাংলাদেশের ফোন নম্বর দুটি হল ০১৫৫২-৩৮৭৯১৩ ও ০১৭১১-১৮৬২৩৯।
ইদানীং কলকাতায় ২৫ লাখ রুপি অগ্রিম দিয়ে যে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তার শেষ কিস্তির জন্য চাপ ছিল প্রমোটরের তরফে। তাই টাকার জন্য ঘন ঘন ঢাকা-চট্টগ্রামে ফোন করছিলেন টাকা পাঠাতে। মাজেদের আত্মীয়দের ফোনে আড়ি পেতেই কলকাতায় তার হদিস পান ঢাকার গোয়েন্দারা। সেই সূত্র ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে জানাতেই কলকাতার পার্কস্ট্রিট থানার ১২ এইচ/৩৪ বেডফ্লোর্ড লেনের এক কামরা ঘরে মাজেদের হদিস মেলে।
পার্কস্ট্রিটের ওসি অলক চৌধুরীর নেতৃত্বে তদন্তে নেমে তল্লাশি চালিয়ে ওই ঘর থেকে একটা হ্যান্ডব্যাগ উদ্ধার করে কলকাতা পুলিশ। ব্যাগে মাজেদের প্রথম স্ত্রী ও তিন সন্তানের ছবি পাওয়া গেছে। কিছু ফোন নম্বর ও সূত্র মিলেছে বলে স্বীকার করেছেন তদন্তকারীরা।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মুরলীধর শর্মা জানিয়েছেন, জারিনা বেগম স্বীকার করেছেন আহমেদ আলি নামে একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে যার ছবি আবদুল মাজেদ বলে পাঠানো হয়েছিল তাকেই জারিনা আহমেদ আলি বলে শনাক্ত করেছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পিজি হাসপাতালে যাচ্ছি বলে বেডফোর্ড লেন থেকে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি আহমেদ আলি ওরফে মাজেদ। পরে তাকে ৬ এপ্রিল রাতে ঢাকায় গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পাওয়া যায় বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী।
ঢাকার গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ১৯৯৬ সালের ১২ মার্চ জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরছেন দেখে বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিম ও রশিদের সঙ্গে দেশ থেকে পালিয়ে যান মাজেদ। প্রথমে ভারত ও পরে পাকিস্তান এবং লিবিয়ায় যান। কিন্তু পরে কলকাতায় এসে ছদ্মনামে নিউমার্কেট থেকে এক কিলোমিটার দূরের তালতলায় ডেরা বাঁধেন। পরে ১২ এইচ/৩৪ বেডফ্লোর্ড লেনের পাঁচতলা বাড়ির দোতলার এক কামরা ঘরে ভাড়া নিয়ে আসেন।
জারিনার কথায়, ১৩০-১৪০ বর্গফুটের ছোট ফ্ল্যাট ছিল। মেঝেতে বসে ক্লাস টু-থ্রির বাচ্চাদের পড়াতেন। কত টাকা পেতেন তা কোনোদিন জানাননি। এদিন বিকালে বেডফোর্ড লেনের ওই বাড়িতে গিয়ে মালিকের দেখা মেলেনি। তবে তিনতলার প্রতিবেশী মনজুর ইলাহী মাজেদ নিয়ে স্বীকার করেছেন, ‘কারও সঙ্গে মিশতেন না, গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। দু-একবার দেখা হলেও শুধু হেসে চলে যেতেন।’
জারিনা স্বীকার করেন, নামাজ পড়ার টানেই বাড়ি থেকে বাইরে যেতেন। কিন্তু কলকাতার মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন দেখে ভারতীয় গোয়েন্দারা নিশ্চিত মাঝেমধ্যেই হাঁটাপথে তিনি নিউমার্কেট এলাকায় আসতেন। যেতেন তালতলায় পুরনো ডেরায়। গৃহশিক্ষকতা ছাড়াও বিপুল পরিমাণ টাকা তিনি সুদের ব্যবসায় খাটাতেন। এ টাকা বাংলাদেশ থেকেই তার কাছে আসত। কিন্তু কাদের মাধ্যমে সেই টাকা তার হাতে পৌঁছাত?
সেই অনুসন্ধানে এখন ব্যস্ত দুই বাংলার গোয়েন্দারা। তালতলায় থাকাকালীনই ভোটার ও আধার কার্ড করে পুরোপুরি ভারতীয় বনে যান। শুধু তাই নয়, ভারতীয় পাসপোর্টও বানিয়ে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি। আদি বাড়ি এ হাওড়ার বাগনান বলে পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের মদদে আধার ও ভোটার কার্ড হলেও কিভাবে পাসপোর্ট হল? পুলিশ ভেরিফিকেশনে কিভাবে বাংলাদেশিকে পার্কস্ট্রিট থানা ছেড়ে দিল তা নিয়েই এখন কৌতূহল বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের।