৭ মার্চের ভাষণ: মানচিত্রে চিড় ধরেছিল সেদিন
সামগ্রিকভাবে ৭ মার্চ ভাষণের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভাষণের শব্দে সামান্য ভিন্নতা থাকলেও এর অর্থ স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী ভাষণ ছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ না করে পরিষ্কারভাবে সেদিন স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিবেদনের জন্য বাঙালিদের প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু।
ঐতিহাসিক গুরুত্বও পেয়েছে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ৪৯ বছর দিনটি রাজনৈতিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রে এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব শুধুমাত্র বাঙলার মুক্তিকামী জাতীয়তাবাদী মন-মানসিকতার মানুষই বুঝতে পারবে।পাকিস্তানের মানচিত্রে এ দিন চিড় ধরেছিল এবং নতুন দিগন্তে বাঁক নিয়েছে ইতিহাস।
১৯৭০ সালের ৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত এলাকায় ৩০টি আসনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন পরের বছর ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কোনো আসন না পেয়েও জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগের এ অভূতপূর্ব বিজয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং জনগণের রায়কে বানচাল করার নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করেন। নির্বাচনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দুই দফা বৈঠকে বসেন। এমনকি ঢাকা থেকে করাচি বন্দরে ফিরে ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের জানান শেখ মুজিবুর রহমান দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী।
ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে শেখ মুজিব ও ভুট্টোর সাথে আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র হবে বলপ স্পষ্ট জানিয়ে দেন। তিনি ১৫ ফেব্রুয়ারি অধিবেশন আহ্বানের দাবী জানান। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে ইয়াহিয়া খান টাল-বাহানা নীতি অব্যাহত রাখেন।
পরবর্তীতে ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষণা করেন ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এর ২ দিন পর আবার ৬ দফা দাবীর রদবদল না হলে অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কথা জানান ভুট্টো। ইয়াহিয়া খান ইতোমধ্যে ভুট্টোর সাথে পরামর্শ করে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।
ইয়াহিয়া খানের এ আকস্মিক ঘোষণায় ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কর্মসূচী প্রদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে এক সভায় সংগ্রামী ছাত্রসমাজ “স্বাধীন বাংলাদেশ” প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। পরিস্থিতি ক্রমশ আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ ঢাকায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সমাবেশে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানান।
রাজনৈতিক এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ পল্টনে এক জনসভায় ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর ৫ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত টানা হরতাল ঘোষণা করেন। পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভায় “স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়। অবস্থার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে বলে ৬ মার্চ ঘোষণা করেন ।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। আগের রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার ভাষণে সামরিক শক্তি ব্যবহারের হুমকিও দিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডও কূটনৈতিক নীতির তোয়াক্কা না করে বলেছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করবে না।
বিকেলে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে পৌছালে সমগ্র ময়দান জনসমুদ্রে ভরে যায়। এটি পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ গণসমাবেশ। মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি তাঁর সমগ্র জীবনের রাজনীতির মূল লক্ষ্য তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে মূলত চারটি দাবি ছিলো। সামরিক আইন প্রত্যাহার, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং বাঙালি হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত এই চারটি দাবীর মাধ্যমে বক্তব্য শেষ করেন বঙ্গবন্ধু।
দেশবাসীকে প্রস্তুতি নিয়ে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রু প্রতিহত করার নির্দেশ দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু নিহত অথবা গ্রেফতার হতে পারেন বলে ধারণা করেছিলেন। যদি আর কোনো নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ না পান সেক্ষেত্রে এই নির্দেশকেই চুড়ান্ত বলে ঘোষণা করেন তিনি।
ঐতিহাসিক এই ভাষণের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন “আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সর্দার সিরাজুল ইসলাম ৭ মার্চের ভাষণকে “মহাকাব্য” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “সাতই মার্চ থেকে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি হয় এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীন দেশের সরকার প্রধানের মতোই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের খাজনা- ট্যাক্স দেয়া বন্ধ করে দেন। পাকিস্তানি সামরিক চিন্তাবিদ জেনারেল কামাল মতিনউদ্দীন তাঁর ‘দ্য ট্র্যাজেডি অব এরর’ গ্রন্থে লিখেছেন, “প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১-এর ৭ মার্চেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়”। এভাবে মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ উপমহাদেশের মানচিত্র বদলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ এন্ড লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়