১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:৪০

বাংলাদেশ যেভাবে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে

  © টিডিসি ফটো

সত্যিকার অর্থে আমি হেনরি কিসিঞ্জারকে দোষী না বানিয়ে পারছি না। তিনি ১৯৭০ দশকে বাংলাদেশকে ‘একটি আন্তর্জাতিক ঝুড়ি বা তলাবিহীন ঝুড়ি’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সন্দেহ নেই যে ধারাবাহিক ধ্বংসাত্মক বন্যার আঘাতের ছবি ও খবর দেশটিকে একটি বিধ্বস্ত জনপদের রূপ দিয়েছিলো। যে চিত্র হতভম্ভ করেছে পুরো পৃথিবীকে।

কিন্তু আজ! বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশ। বিশ্বের অন্যান্য শক্তি বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মতামত পরিবর্তনে বিলম্ব করতে পারে। তবে আমরা ভারতীরা বাংলাদেশকে বিচারে ১৯৭০ সালে পড়ে থাকার কোন সুযোগ বা অধিকার নেই। কিন্তু গত সপ্তাহের আমাদের কণিষ্ঠ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তেমনই মত প্রকাশ করলেন। 

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিশান রেড্ডি বলেছেন ‘ভারত যদি নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দেয় তবে বাংলাদেশের অর্ধেক অংশ খালি হয়ে যাবে’। ‘নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিলে অর্ধেক বাংলাদেশি ভারতে চলে আসবেন’ এমন মন্তব্য করেন রেড্ডি। এমন অকূটনৈতিক ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রমাণ করে রেড্ডি বাংলাদেশের সত্যিকারের অবস্থা সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ। 

সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে-সব ক্ষেত্রে না হলেও, জীবনমান নির্ধারনী অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে ভারতের তুলনায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে সেটাও অনিস্বীকার্য।

প্রথমত, বাংলাদেশ এমন হারে উন্নয়ন হচ্ছে- যেটা নিয়ে আমরা ঈর্ষা করতে পারি।  এ হার আমরা দু্ থেকে তিন বছর পরেও অর্জনের আশা করতে পারি। আমরা যখন ৫ শতাংশের কম জিডিপি নিয়ে এগুচ্ছি, বাংলাদেশ তখন জিডিপি’র ৮ শতাংশে উন্নীত করার পথে এগিয়ে চলছে।

দ্বিতীয়ত, চীনকে পরিত্যাগ করে নির্মলা সীতারামন যখন ১৫ শতাংশ হারে কর্পোরেট করের প্রস্তাব দিয়ে বিনিয়োগকে খুঁজছেন তখন বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশে চীনের এসব বিনিয়োগ যাচ্ছে। এতে করে লন্ডন এবং নিউইয়র্কের প্রধান প্রধান সড়কে যখন বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কাপিয়ে দিচ্ছে তখন লুধিয়ানা এবং ত্রিপুরার পণ্য খুঁজে পাওয়া দায়।

বিষ্ময়কর হলেও সত্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি ডাবল ডিজিটে বৃদ্ধি পেয়ে আর ভারতের রপ্তানি বড় আকারে কমেছে। অর্থনৈতিক এ অগ্রগতি ভারত ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পার্থক্যের একটি অংশমাত্র। 

অন্যান্য বিষয় বলে শেষ করার নয়। যেমন বাংলাদেশের জীবন ভারতের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বাংলাদেশে পুরুষ ও মহিলাদের গড় আয়ু যথাক্রমে ৭১ এবং ৭৪ বছর। ভারতে যেটি পুরুষের ক্ষেত্রে ৬৭ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৭০ বছর। এই ব্যবধানটিকে ভালো করে দেখলে পার্থক্যটি আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। 

প্রথমত, শিশুদের ক্ষেত্রে দিয়ে যদি শুরু করি। বাংলাদেশের নবজাতকের মৃত্যূহার প্রতি হাজারে ১৭.১২। অথচ ভারতে এটি ২২.৭৩। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার ২৫.১৪ কিন্তু ভারতে এটি ২৯.৯৪ । ভারতে পাঁচ বছর বয়সী ৩৮.৯ ; যেটি বাংলাদেশে ৩০.১৬।

বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সের নারীদের স্বাক্ষরতার হার ৭১% যেটি ভারতে ৬৬%। বাংলাদেশে নারীরে শ্রমের অংশগ্রহণ ৩০% এবং যে ক্রমে বাড়ছে; অথচ ভারতের যার অংশগ্রহণ মাত্র ২৩ %।
পরিশেষে, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের ভর্তির অনুপাতে দেখা যায়- ভারতে এ প্রবৃদ্ধির হার শূণ্য দশমিক ‍৯৪। বাংলাদেশে এটি এক দশমিক ১৪। সীমান্তের অপর পারে সব কিছু কেবল ভাল নয়; তারা এখনও আরও ভাল হতে চলেছে। আর আমরা পিছনে পড়ে যাচ্ছি।

সুতরাং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন যে বলেছেন, ‘কিছু ভারতীয় নাগরিক অর্থনৈতিক কারণে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে’- তার বক্তব্য সঠিক না হওয়ার কোন কারণ নেই। 

মানুষ তাদের জীবন উন্নতির জন্য ভারত ছাড়ছে এবং বাংলাদেশের জীবন ভাল মনে করে সেখানে অভিবাসন করছে। আপনি যদি কোনও ভারতীয় মুসলমান হন এবং আপনার জীবন গো-মাংসের কারণে গণপিটুনিকে মৃত্যুকে ভয় পান, অথবা কোন হিন্দু নারীর প্রেমের পড়ার কারণে মরার আশংকা থাকেন, আপনি সহজেই দেশ ছাড়বেন।

এই মুহুর্তে, বিপরীত দিকে যাত্রার জন্য খুব বেশি ঝোঁক থাকতে পারে না। উপরের তথ্য উপাত্ত থেকে এটুকু বোঝা যায়, ভারতের আইনি নাগরিক হয়ে থাকার চেয়ে বাংলাদেশে বস্তিতে থাকা আরও বেশি আকর্ষণীয়। 

পরিশেষে একটি বিষয়ে বলতে চাই যা রেড্ডির জানা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র যদি নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেয় তবে অর্ধেক ভারত ফাকা হয়ে যাবে। বাস্তবে এটি আরও ভয়াবহও হতে পারে। যাইহোক, আমেরিকার বন্ধ দরজাও কিন্তু আমাদের থামতে পারছে না। 

  • গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এ কলামটি ইংরেজি ভাষা থেকে অনূদিত।