অবসরে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে বিচারপতির মুসলিম বিদ্বেষী রায়
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৩০ PM , আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:৩০ PM
ভারতের অযোধ্যার আলোচিত বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি মামলার রায়ে মসজিদ নির্মাণে সরকারকে অন্যত্র পাঁচ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের রায়ে বলা হয়, মসজিদের নিচে স্থাপনা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এটি মন্দির কি না, তা নিশ্চিত নয়।
২ দশমিক ৭৭ একর বিরোধপূর্ণ জমিতে মন্দিরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। ওই জমিতেই বাবরি মসজিদ ছিল।
আজ শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ভারতের বহুল আলোচিত এই মামলার রায় পড়া শুরু করেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে গড়া পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ। এ রায় ঘোষণাকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০ অক্টোবর থেকে অযোধ্যা শহরে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে।
এ বিষয়ে আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. তুহিন মালিক একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেন, আসলে যে বিচারপতি আসামের এনআরসির নির্দেশ দিয়েছিলেন, আজ তিনিই সপ্তাহ পর অবসরে যাওয়ার আগ মুহুর্তে আরেকটি মুসলিম বিদ্বেষী রায় দিয়ে গেলেন। চরম হিন্দুত্ববাদী ভারত রাষ্ট্রের অশুভ যাত্রাপথকে এই রায়ের মাধ্যমে আরো বেশী উৎসাহিত করা হলো। এরফলে এখন থেকে আরো বেশী মাত্রায় গোরক্ষার নামে নির্বিচারে মুসলিম হত্যা করা হবে! এনআরসির বাহানা দিয়ে ভারতের মুসলমানদেরকে নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নের আদালতি সুরক্ষাও এখন পাওয়া গেলো! আর যেমনি করে আজ বাবরি মসজিদের পরিবর্তে অন্যত্র একটি জায়গা বরাদ্দ দেয়া হলো, তেমনি করেই এখন ভারতের মুসলমানদেরকে নিজেদের মাতৃভূমির বদলে বাংলাদেশ নামক জায়গাটি বরাদ্দ দেয়া হবে!
তিনি আরও লিখেন, ‘‘বাবরি মসজিদের নিচে থাকা স্থাপনাটি ঠিক কী ছিল। তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)। ‘রাম মন্দিরের জায়গায়ই বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল’- এ কথাটাও কোর্টে সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করা যায়নি। ফলে, কাল্পনিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রদত্ত রায়টি মন্দিরের পক্ষেই গিয়েছে।
ভারতের সংবিধানে ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে ভারতের সকল নাগরিকবৃন্দের জন্য ন্যায়বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
অথচ আজকের বির্তকিত রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাদের সংবিধানের এই মূল ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ‘নির্মোহি আখাড়া’র পক্ষে রায় দিয়েছে। ভারতের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট Complete Justice বা ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের’ জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, সেইরূপ নির্দেশ বা আদেশ দিতে পারবে। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচারের সাংবিধানিক শপথধারী ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট আজকে নির্লজ্জভাবে অপ্রমানিত মন্দিরের পক্ষেই তাদের এই Complete Justice বা ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের’ তত্ত্বটির প্রয়োগ করলো!
ভুললে চলবে না যে, আইন-আদালত জমির মালিকানা নির্ধারণ করতে পারে, কিন্তু মানুষের ধর্মস্থান ও ধর্মীয় বিশ্বাস নির্ধারণের ক্ষমতা কোন আদালতের নাই। আদালত বিরোধ নিস্পত্তির জায়গা। অথচ ভারতের আদালত বিরোধ নিস্পত্তির পরিবর্তে আজকে আরেকটি বিরোধের জন্ম দিলো!
আশ্চর্য এক রায়! আদালত বাবরি মসজিদ ভাঙাকে বেআইনী বললেও, যারা এই বেআইনী কাজটা করে একটা মসজিদকে শত কোটি মানুষের চোখের সামনে ভেঙে চুরমার করে দিলো তাদের কোন বিচার বা শাস্তি কোনটাই দেয়া হলো না!’’
এদিকে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিশ্বাস, উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ভগবান রামচন্দ্র জন্মেছিলেন। তাঁর জন্মস্থান বলে চিহ্নিত জায়গায় ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট বাবরের আমলে একটি মসজিদ তৈরি হয়। নাম দেওয়া হয় বাবরি মসজিদ। মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি নিয়ে সেই থেকে হিন্দু-মুসলিম যে বিরোধ চলছিল, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তা অন্যদিকে বাঁক নেয়। ওই দিন কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেন। এ নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অন্তত দুই হাজার লোক নিহত হয়। সেই থেকে বাবরি মসজিদের ২ দশমিক ৭৭ একর জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধিতা শুরু হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্ট ওই জমি বিবদমান তিন পক্ষ রাম লালা, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ও নির্মোহী আখড়ার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করার নির্দেশ দেন। তবে সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ হয় সুপ্রিম কোর্টে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, মসজিদটি ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ হয়নি। এর নিচে অন্য কাঠামো ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননের ফলে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, এতে বোঝা গেছে সেগুলো ইসলামি নয়। অযোধ্যায় বিকল্প স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মন্দিরের জন্য সরকারকে ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ট্রাস্ট গঠন করতে হবে। বিরোধপূর্ণ জমি চলে যাবে ট্রাস্টের কাছে।
রায়ে বলা হয়, বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।