১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:২৩

স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে দেড়বছরে ১৩ বার সচিবের বিদেশ সফর

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো—বিবিএস যে বিভাগের আওতাধীন, সেই পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী এখানে যোগদানের পর থেকে গত ১৯ মাসে ১৩ বার বিদেশ সফর করেছেন। গত বছরের ৩০ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে (সিড) যোগদানের পর এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা এবং পূর্ব আফ্রিকার মরিশাসেও ভ্রমণ করেছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা। সচিবদের বিদেশ ভ্রমণের ফাইল অনুমোদন প্রধানমন্ত্রীর হাতে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১৩ সালের এক নির্দেশনায় বলা আছে, একজন সচিব বছরে চারবারের বেশি বিদেশ সফরে যেতে পারবেন না।

সিড সচিবের ১৩ বার বিদেশ সফরের সব কটি নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী যতবারই বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, বেশির ভাগ সময়ই কখনো স্ত্রী, কখনো দুই সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। সরকারি আদেশে উল্লেখ ছিল, বিদেশ ভ্রমণে পরিবারের সদস্যদের সব খরচ সচিব নিজে বহন করবেন।

সচিবের ঘন ঘন বিদেশ সফর ভালোভাবে নিচ্ছেন না পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এই বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারাও সচিবের বিদেশ ভ্রমণপ্রীতিতে ক্ষুব্ধ। তাঁরা বলছেন, বিভাগের প্রধান যদি এভাবে ঘন ঘন বিদেশ সফরে যান, তখন সংস্থার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সচিব যতবার বিদেশ ভ্রমণে গেছেন, তার বেশির ভাগই ছিল শিক্ষা সফর। এসব সফরে অধস্তন কর্মকর্তাদের পাঠালে তাঁরা বেশি উপকৃত হতেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশে ষষ্ঠ জনশুমারি (আদমশুমারির নাম এবার থেকে হবে জনশুমারি) করার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত ১ সেপ্টেম্বর চীন সফরে যান সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী। পাঁচ সদস্যের সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন সচিবের ছেলে শৈব চক্রবর্ত্তী। সচিবের পাঁচ দিনের ওই সফরের সব খরচ বহন করা হয়েছে বিবিএসের চলমান কৃষিশুমারি প্রকল্প থেকে। সরকারি আদেশে বলা আছে, সচিবের ছেলের সব খরচ সচিব নিজে বহন করবেন। বিবিএসের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে পঞ্চম আদমশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। ষষ্ঠ জনশুমারির প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে বিবিএস, যদিও প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন পায়নি। জনশুমারি প্রকল্প অনুমোদন না পেলেও সচিবের ওই সফরের খরচ কৃষিশুমারি প্রকল্প থেকে নেওয়া হয়েছে, যা অস্বাভাবিক।

মালদ্বীপে আদমশুমারির কাজ দেখতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি মালদ্বীপ সফরে যান সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী। ৩ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি সেখানে অবস্থান করেন তিনি। এই সফরের পুরো খরচ বহন করা হয় বিবিএসকে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প থেকে। এখানে তাঁর সফরসঙ্গী হন তাঁর স্ত্রী রক্তিমা চক্রবর্ত্তী, তবে স্ত্রীর খরচ সচিবকেই বহন করার কথা বলা আছে জিওতে।

পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ রাষ্ট্র মরিশাসের পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে গত ২ জুলাই সে দেশে যান সচিব সৌরেন্দ্রনাথ। ছয় দিনের ওই সফরে চার সদস্যের সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী। ছয় দিনের এই সফরের খরচ বহন করা হয়েছে বিবিএসের সিআরভিএস নামের একটি প্রকল্প থেকে।

 

এর আগে আগস্ট মাসে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যান সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী। সেখানেও সফরসঙ্গী ছিলেন তাঁর স্ত্রী। একই সফরে সস্ত্রীক নেদারল্যান্ডসেও যান তিনি।

দক্ষিণ কোরিয়ার জনশুমারির তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া দেখতে গত ৬ মে সে দেশে সফরে যান সচিব সৌরেন্দ্রনাথ। পাঁচ সদস্যদের প্রতিনিধিদল ঢাকায় ফিরে আসে ১০ মে। সচিবের এই সফরের সব খরচ বহন করা হয় বিবিএসের তাঁতশুমারি থেকে। এই সফরেও সচিবের সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী। জাতিসংঘের ৫০তম পরিসংখ্যান কমিশনের সেশনে অংশ নিতে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে আট মার্চ যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান সচিব। তিন সদস্যের এই প্রতিনিধিদলের সব খরচ বহন করে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল। জাতিসংঘের এই সফরে সৌরেন্দ্রনাথের আরেক ছেলে শোভন চক্রবর্ত্তী যান যুক্তরাষ্ট্রে। ছেলের খরচ সচিবই বহন করবেন বলে সরকারি আদেশে বলা হয়েছে।

গত বছর ৫ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ভুটান সফরে যান সচিব। ওই সফরে প্রতিনিধি সংখ্যা ছিল পাঁচ। সফরের পুরো টাকা বহন করা হয়েছে তাঁতশুমারি থেকে। এখানেও তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন স্ত্রী রক্তিমা চক্রবর্ত্তী ও ছেলে শৈব চক্রবর্ত্তী। স্ত্রী ও ছেলের খরচ নিজেই বহন করবেন বলে সরকারি আদেশে উল্লেখ ছিল। এটিও ছিল শিক্ষা সফর।

গত বছর ২৯ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ভারত সফরে যান সচিব। তিন সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের পুরো খরচ বহন করা হয়েছে বিবিএসের এনএসডিএস প্রকল্প থেকে। অন্যদিকে গত বছরের মাঝামাঝি তুরস্ক সফরে যান তিনি। মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি) প্রকল্প থেকে সব খরচ বহন করা হয়।

তথ্য বলছে, গত বছর নভেম্বরে রাশিয়া সফরে যান সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী। ওই সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী। সফরে রাশিয়ার পরিসংখ্যান বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সচিব। সচিবের ফেসবুক পেজে রাশিয়াসহ সবগুলো দেশ সফরের বেশ কিছু ছবি আপলোড করা হয়েছে।

সচিবের সঙ্গে স্ত্রী-পুত্রের সফরের খরচ কিভাবে জোগানো হয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও জানা যায়নি। তবে এটা জানা গেছে যে, ওই ১৩ দেশে সচিবের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অথবা পুত্র—কেউ না কেউ ছিলেনই; কোনো কোনো দেশে আবার দুজনই ছিলেন। ট্রাভেলিং এজেন্সি ট্যুরিজম উইন্ডোর সিইও মনিরুজ্জামান মাসুমের কাছে জানতে চাইলে তিনি হিসাব দেন, ওই ১৩ দেশে একজনের গড়ে পাঁচ দিন করে ভ্রমণে গরিবানা হালে ধরলেও কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা খরচ হবে।

বিষয়টি গত ১৮ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সামনে তুললে মন্ত্রী বলেন, ‘পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিবের ওই ১৩ সফরের সব কটি প্রয়োজনীয় ছিল না। অনেকটাই অহেতুক ও অপ্রাসঙ্গিক। স্বল্প সময়ের শিক্ষা সফরে সচিবের বিদেশ যাওয়ার সঙ্গে আমি একমত নই। আমি হলে যেতাম না।’