আমাদের যত ভয় দেখানো হচ্ছে, আমরা তত ভয় পাচ্ছি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নিহত হবার পর অভিযোগ উঠেছে যে, সামাজিক মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশের কারণেই তার ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এরপর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশ ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে কি না।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং সমাজের সব ক্ষেত্রেই পরমত সহিষ্ণুতা কমে যাবার কারণেই ভিন্নমত প্রকাশ বা সরকার বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোন মতামত প্রকাশকেই ভালো চোখে দেখা হয় না।
এর পেছনে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের কার্যকর শক্তি হয়ে ওঠার ব্যর্থতা এবং নাগরিকদের প্রতিবাদ না করাকেই দায়ী করেন অনেকে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশ ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ‘আমরা ক্রমাগত দেখছি যে আমাদের মত প্রকাশের যে অধিকার তার পরিসরটা কমে আসছে।’
তিনি বলেন, ‘বুয়েটের ঘটনা এজন্য একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক উদাহরণ, যে মত প্রকাশ করলে, সেটা যদি কারো পছন্দ না হয় এবং যাদের পছন্দ হয়নি তাদের পেছনে যদি সরকারি আনুগত্য থাকে তাহলে বিপজ্জনক হবে ঘটনা।’
২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিভাগের সহকর্মীদের করা অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।
অভিযোগ করা হয়েছিল তিনি ফেসবুকে সহকর্মীদের সম্পর্কে ‘অসম্মানজনক’ কথা লিখেছেন ফেসবুকে। কিন্তু তিনি দাবি করেছেন ঐ অভিযোগ ছিল ‘অমূলক’।
‘আসলে যে অভিযোগ করা হয়েছিল, সে রকম ঘটনাই ঘটেনি। বরং বিভাগের কিছু বিষয় নিয়ে আমি কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছিলাম। সেটি পছন্দ হয়নি অনেকের। সে কারণে আমাকে হেনস্থা করার জন্যই ঐ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।’ এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
‘ঐ অভিযোগ সম্পর্কে আদালতে কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেননি তারা।’ ঘটনার দুই বছরের বেশি সময় পরে ২৫শে অগাস্ট রুশাদ ফরিদীর বাধ্যতামূলক ছুটির আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বাংলাদেশে বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশের কারণে হত্যা, হামলা ও মামলা দায়েরর ঘটনা নতুন নয়। ২০১৩ সাল থেকে জঙ্গিদের হাতে কয়েকজন লেখক ও ব্লগার নিহত এবং আহত হবার ঘটনা ঘটেছে। তবে লেখক ও ব্লগারদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো চোরাগোপ্তা হামলা ছিল।
গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের ওপর যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের পরিচয় নিয়ে অভিযোগের তীর ছিল ছাত্রলীগ কর্মীদের দিকেই। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশের কারণে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে।
এর মধ্যে ফেসবুকে সরকারের সমালোচনা কিংবা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি এমন অভিযোগে মামলা হয়েছে বেশ কয়েকটি। এই মূহুর্তে বাংলাদেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইবুনালে তেরোশ’র বেশি মামলা বিচারাধীন আছে। এসব মামলার অর্ধেকের বেশি দায়ের করেছেন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা।
যে কারণে সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করেন এমন ব্যক্তিদের অনেকে এখন সাবধানী হয়ে লেখেন, কেউ কেউ লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাবেরী গায়েন।
‘এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ভিন্নমত প্রকাশ কেবল বিপজ্জনক নয়, সেটা বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের সমালোচনা করলেই আক্রান্ত হতে হবে এমন একটি আতংক রয়েছে অনেকের মধ্যে।’
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি, বিশেষ করে একটি কার্যকর বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতির কারণে ভিন্নমত সম্পর্কে অসহনশীলতা তৈরি হয়েছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, ‘একটা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সহনশীলতার সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক পরিবেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, সহনশীলতা থাকবে এবং ভিন্নমত থাকবে। সেই মতকে প্রতিবাদ করতে হলে মতবাদ হিসেবে প্রতিবাদ করতে হবে, শক্তি দিয়ে নয়। নির্যাতন দিয়ে কণ্ঠরোধ করা যাবে না।’
‘সেই পরিবেশ, পরমত সহিষ্ণুতা এখানে গড়ে ওঠেনি। হতাশার ব্যপার হচ্ছে নির্যাতনের এই পরিবেশ ক্রমে বাড়ছে। (বুয়েটের) এই তরুণের ওপর আক্রমণকে মত প্রকাশের ওপর আক্রমণ বলেই মনে হয়েছে আমার।’
বুয়েটের এই ঘটনার পরে দেশের প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে বিক্ষোভ হচ্ছে, তাতে অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ তুলছেন যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে প্রায়ই নিগ্রহের শিকার হতে হয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের।
তবে সামাজিক মাধ্যমে সরকারবিরোধী সমালোচনা প্রকাশের কারণে কেবল শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক এবং লেখক ও সাংবাদিকদেরও হামলা ও মামলার শিকার হতে দেখা গেছে।
অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলছেন, ‘আমরা দেখেছি কেউ সরকারবিরোধী মতামত দিলে বা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কিছু বললে তাদের কিভাবে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।’
‘সরকারবিরোধী পোস্টের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আলোকচিত্রী শহীদুল আলমকে কারাভোগ করতে হয়েছে। এগুলো দুয়েকটি উদাহরণ, কিন্তু সারাক্ষণই সামাজিক মাধ্যমে মনিটর করা হচ্ছে এবং যারা লেখালেখি করেন সবাই একটা আতংকের মধ্যে রয়েছে।’
এ ধরণের একটি পরিবেশ তৈরির পেছনে রাজনৈতিক অসহনশীলতার সঙ্গে সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ না করাটাকেও দায়ী করেন অধ্যাপক গায়েন।
‘যখনই কোন সমাজে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে অকার্যকর হয়ে যায় তখন এমন হয়। একটা সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের যে ভূমিকা নেবার প্রয়োজন ছিল, সেটা করতে পারিনি আমরা। নাগরিকদেরও প্রতিবাদ সে অর্থে জোরালো নয়। ফলে আমাদের যত ভয় দেখানো হচ্ছে, আমরা তত ভয় পাচ্ছি।’
অধ্যাপক গায়েন বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের ব্যপারে মানুষ মুখ খোলে না, এটা ভয়ের ব্যপার। ‘সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে এই পরিবেশ থামানো যাবে।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা