বাংলা একাডেমিতে জটিলতা
২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলা একাডেমি আইন প্রণীত হওয়ার ৬ বছর পরও প্রতিষ্ঠানটির প্রবিধান প্রণয়ন হয়নি। যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিতে সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ জটিলতা। দেখা দিয়েছে বেতনবৈষম্য। ব্যাহত হচ্ছে পদোন্নতি, নিয়োগসহ নানা কার্যক্রম। ফলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ, জন্মেছে হতাশা। কাজকর্মের গতিশীলতাও কমে এসেছে। এছাড়া বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন ও গবেষণার জন্য মূলত প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হলেও গত দশ বছরে হাতেগোনা কয়েকটি কাজ ছাড়া গবেষণার কাজ তেমন হচ্ছে না।
প্রবিধান প্রণয়নে দেরির বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সংসদ ও আইন) শওকত আলী সাংবাদিকদের বলেন, প্রবিধান তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি এ বছরের মধ্যেই প্রবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন হবে। বাংলা একাডেমির প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক ডা. কেএম মুজাহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, অতি দ্রুত কাজ চলছে। আশা করছি প্রবিধান তৈরির কাজ শিগগির সম্পন্ন হবে।
প্রবিধান প্রণয়নের বিষয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় সচিব পরিবর্তন হওয়ায় প্রবিধান তৈরির কাজটি পিছিয়েছে। পাশাপাশি এ কাজে এক ধরনের অবহেলাও লক্ষ্য করা গেছে। বাংলা একাডেমিতে সর্বশেষ পদোন্নতি হয় ২০১২ সালে। এরপর কোনো পদোন্নতি হয়নি সেখানকার কর্মকর্তাদের। আর এর পেছনে বারবার অজুহাত হিসেবে কাজ করেছে এই ‘প্রবিধান’। এ নিয়ে মিটিংয়ের পর মিটিং হলেও প্রবিধান প্রকাশ হয়নি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই ঘটে গেছে বেতনবৈষম্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রীর এক ঘোষণার ফলে গত ১০ বছরে পদোন্নতি হয়নি এমন অনেক কর্মকর্তার বেতন বেড়েছে, কিন্তু উচ্চপদে আসীন অনেক কর্মকর্তার বেতন বাড়েনি। ফলে অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার চেয়ে অনেক জুনিয়র কর্মকর্তা এখন বেশি বেতন পাচ্ছেন।
আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সঠিকভাবে নিয়োগ বন্ধ থাকায় সাবেক মহাপরিচালক তার সময়ে অর্ধশতাধিক জনবল অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেন। তাদের বেতন এখন বাংলা একাডেমিকেই দিতে হয়, যা মূলত আসে বই বিক্রির টাকা থেকে। যে কারণে একাডেমি তহবিল সংকটে আছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, দীর্ঘসময় পদোন্নতি বন্ধ ও বেতনবৈষম্য সৃষ্টি হওয়ায় একাডেমির লোকজনের মধ্যে কর্মস্পৃহা নেই। ‘চেইন অব কমান্ড’ সঠিকভাবে কাজ করছে না। কর্মীদের ভেতরে জন্ম নিয়েছে চাপা ক্ষোভ। যে কোনো মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটি ‘কলাপস’ করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলা একাডেমিতে মোট বিভাগ রয়েছে ৮টি। এগুলো হল- গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ; অনুবাদ, পাঠ্যপুস্তক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ; জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ; বিক্রয় বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ; সংস্কৃতি, পত্রিকা ও মিলনায়তন; গ্রন্থাগার; ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা; প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। এর মধ্যে দুটি বিভাগে কোনো পরিচালক নেই। উপ-বিভাগের হিসাবে যে ক’জন উপ-পরিচালক থাকার কথা ছিল তাও নেই।
আরেকটি সূত্র জানায়, গত মাসের মাঝামাঝি পদোন্নতিসহ নানা সমস্যা সমাধানে একটি মিটিং ডাকা হয়। সেখানে মন্ত্রণালয় ও একাডেমির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেই মিটিংয়েও প্রবিধান ছাড়া পদোন্নতি সমীচীন হবে না- এমন সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ছয় বছরেও আলোর মুখ দেখেনি ‘প্রবিধান’। এর প্রভাব পড়েছে গবেষণার ক্ষেত্রেও। গত দশ বছরে হাতেগোনা কয়েকটি কাজ ছাড়া বাংলা একাডেমিতে সেই অর্থে কোনো বড় গবেষণার কাজ হয়নি। বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান, আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা- এমন কিছু হাতেগোনা গবেষণা ও গ্রন্থ প্রকাশ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কাজ নেই। এর মধ্যে ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’র সব জেলার বই এখনও প্রকাশ হয়নি। তাছাড়া প্রকাশিত বইগুলোর মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। নেই গবেষণা কাজের ধারাবাহিকতা।
বাংলা একাডেমিতে নিয়মিত গবেষণা কাজ পরিচালনার জন্য কিছু জনবল থাকলেও কোনো ‘ডেডিকেটেড’ টিম নেই। গত কয়েক বছর গবেষণার কাজে বাইরে থেকে নিয়ে কাজ করার প্রবণতাই বেশি দেখা গেছে। বাংলা একাডেমির একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমান মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রতিষ্ঠানটিকে কর্মচাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। কিন্তু এর মধ্যেও গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে প্রবিধান না হওয়া এবং তার ফলে সৃষ্ট পদোন্নতি না হওয়াসহ নানা জটিলতা।