ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্কুলে স্কুলে সচেতনতামূলক সমাবেশ
রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা নিয়েই জোরদার করা হয়েছে বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা অভিযান। ছাত্রছাত্রীরা তাদের শ্রেণিকক্ষ পরিস্কার করতে স্বতঃস্ম্ফূর্ত সহযোগিতা করছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় প্রায় প্রতিদিনই মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। স্কুলমাঠে জমে থাকা পানি অপসারণ, টয়লেট ও ছাদ পরিস্কার করা হচ্ছে। অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে সচেতনতামূলক লিফলেট ছেপে আশপাশের এলাকায় বিতরণ করতেও দেখা গেছে।
এছাড়া ডেঙ্গুর লার্ভাবাহী এডিস মশার বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, স্কাউট ও রোভার লিডারদের সহযোগিতা চেয়েছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়ররা। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সিটি করপোরেশন থেকে সরবরাহ করা ছক অনুসারে নিজ পরিবারের ও প্রতিবেশীদের ডেঙ্গু আক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করছে শিক্ষার্থীরা। এসব তথ্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা সিটি করপোরেশনে জমা দেবেন। রাজধানীর বড় ও খ্যাতনামা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতা-সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ ও ভবনগুলো নিয়মিত পরিস্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য রাখা ফুলের টব নিয়মিত পরিস্কার করতে হবে। মাঠ কিংবা ভবনে জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে।
সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত অবহিত করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশের পর ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। বৃহস্পতিবার সব জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে পাঠানো এক নির্দেশে এ কথা জানানো হয়। অন্যদিকে, সব বিশ্ববিদ্যালয়কে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করতে ও নিয়মিত ক্যাম্পাস পরিচ্ছন্ন রাখতে অনুরোধ জানানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানকে পৃথক চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের দায়িত্বে থাকা মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান সমকালকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ও মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। সারাদেশের বিদ্যালয়গুলোতে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরও জোরদার করার জন্য মাউশি থেকে পৃথক আরেকটি পরিপত্র জারি করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। মাউশি মহাপরিচালক ঢাকার বাইরে রয়েছেন। তিনি ফিরে এলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর স্কুলগুলোতে দুই সপ্তাহ ধরেই পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। মেয়েদের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বেইলি রোডের প্রধান ক্যাম্পাস ছাড়াও আজিমপুর, ধানমণ্ডি ও বসুন্ধরায় তিনটি শাখা হয়েছে। সব ক্যাম্পাস মিলে এ মুহূর্তে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীসংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেরদৌসী বেগম জানান, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর এখন সকাল-বিকেল দু’বেলা দুই শিফটে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। টয়লেট, ছাদ, মাঠ- সর্বত্র জমে থাকা পানি নিয়মিত নিস্কাশন করা হচ্ছে। শাখাপ্রধানদের মোবাইল ফোনে নিয়মিত এসএমএস পাঠিয়ে তিনি পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম তদারক করছেন। সিটি করপোরেশন থেকেও নিয়মিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ছাত্রীদের উপস্থিতিও ডেঙ্গুর কারণে কমেনি।
রাজধানীর আরেক বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৮ হাজার। মতিঝিলে মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও মুগদা ও বনশ্রীতে এ বিদ্যালয়ের আরও দুটি শাখা রয়েছে।
অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে শিক্ষার্থীরাও সচেতন হয়েছে। নিজেদের ক্লাসরুম নিজেরাই পরিচ্ছন্ন রাখছে। তারা শিগগির এ বিষয়ে অভিভাবক সমাবেশ করবেন।
এদিকে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র পৃথকভাবে নিজ নিজ এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সহযোগিতা চেয়েছেন। স্কাউট ও রোভারদেরও সহায়তা চান তারা। দক্ষিণ সিটি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন গত শুক্রবার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে দক্ষিণের সব প্রতিষ্ঠানপ্রধান, রোভার স্কাউট লিডারদের নিয়ে বসেছিলেন।
সেখানে প্রতিটি ওয়ার্ড কমিশনারের নেতৃত্বে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ওই ওয়ার্ডের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের একযোগে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময় সিটি করপোরেশন থেকে একটি ছক তাদের দেওয়া হয়। শুক্রবার বিকেলে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম একইভাবে উত্তরের সব প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরের আইডিয়াল গার্লস ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটে সভা করেন। সেখানেও একই সরকারি কর্মকর্তারা অংশ নেন।
মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন জানান, প্রধান দুটি ক্যাম্পাস ছাড়াও তার প্রতিষ্ঠানের রূপনগর, শেওড়াপাড়া ও ইব্রাহীমপুর তিনটি শাখা মিলিয়ে ৪০ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। ডেঙ্গু ও গুজব প্রতিরোধে গত শনিবার দুপুরে প্রধান (বালিকা) ক্যাম্পাসে তারা সভা করেছেন। এতে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, পুলিশের মিরপুর জোনের ডিসি মোশতাক আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বুধবার বিকেলে প্রধান (বালক) ক্যাম্পাসেও তারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করেন।
মিরপুর-১ নম্বর এলাকার মিরপুর সিদ্ধান্ত হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, মেয়রের দেওয়া ছক তারা শিক্ষার্থীদের দিয়েছেন। সবাই বাড়ি থেকে তথ্য পূরণ করে নিয়ে আসবে। এর বাইরেও বিদ্যালয়ের খরচে তারা জনসচেতনতামূলক লিফলেট ছেপে বিলি করবেন। বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চার গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে এই প্রধান শিক্ষক জানান।
রাজধানীর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও চলছে নানা কার্যক্রম। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, জেলা প্রশাসনের দেওয়া গাইডলাইন অনুযায়ী এডিস মশা ও ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানানো হচ্ছে। ওয়ার্ড কমিশনারের নেতৃত্বে তার বিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকায় তারা মানুষকে সচেতন করতে কাজ শুরু করেছেন। তার বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তিন হাজার ২৫০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে বলে জানান।
ধানমণ্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, অ্যারোসল স্প্রে, ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করে ক্লাস, টয়লেট সবকিছু পরিস্কার করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনে খবর দিয়ে ওষুধ ছিটানো অব্যাহত রেখেছেন। দুই হাজার ৮০০ শিক্ষার্থীর এ বিদ্যালয়ে এরই মধ্যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুটি অভিভাবক সমাবেশ করেছেন। শিগগির আরেকটি করবেন বলেও জানান।