‘মা চকলেট আনতে গেছে’ বলেই জানে ছোট্ট তুবা
সাড়ে ৩ বছর বয়সী শিশু তাসনিম তুবার কাছে পাওয়া-না পাওয়ার পার্থক্য নেই। নেই জীবন-মৃত্যুর আলাদা কোনো মানে। পরম স্নেহে ঘুম পাড়ানি গান শুনতে শুনতে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে যাওয়ার বয়স তার। কিন্তু এ বয়সেই তুবাকে মায়ের আদর-স্নেহ বঞ্চিত হতে হবে, কে জানতো? গত তিন দিন রাত পেরিয়ে দিন এলেও মা আসেনি চকলেট নিয়ে। আর আসবেও না কখনো তুবাকে দেখতে। কিন্তু তুবাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলেই বলছে, ‘মা চকলেট আনতে নিচে গেছে’।
প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারানো তাসলিমা বেগম রেনু (৪০) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল রবিবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রতিদিনের মতই সেদিনও মা তাসলিমা বেগম রেনু কাজে বের হন। আদরের ছোট্ট শিশুটিকে বলে যান মা আসার সময় তোমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবো আর বাসায় এসে আদর করে বুকে টেনে নিবেন, সেই আশাতেই হয়তো অপেক্ষা করছিল ছোট্ট তুবা। কিন্তু সময় গড়িয়ে প্রায় তিন দিন পার হতে চললেও অপেক্ষা আর ফুরায় না তার।
এখনো মাঝে মধ্যে মনে পড়লে মাকে খুঁজে ফিরে অবুঝ শিশুটি। কারণ সে এখনও জানেও না, পৃথিবীতে তাকে আগলে রাখার কেউ রইল না আর। তুবার জন্মের দেড় বছর পরেই পারিবারিক কলহের নিষ্ঠুরতায় বাবার প্রস্থানের পর শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল মমতাময়ী ওই মা, এক গুজবের নামে দানবের হাতে শিকার হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলেন তিনিও।
তুবার খালা কুসুম বেগম বলেন, তুবা মাঝে-মধ্যেই তার মাকে খোঁজে। তখন আমরা মা চকলেট আনতে গেছে বলে সান্ত্বনা দেই। সে তো ছোট মানুষ, কিছু বুঝে না-মা একটু পর আসবে বলে অন্যদিকে মনোযোগ ফিরিয়ে দেই। তারপর সে আবার খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার মা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই ধাক্কা সে সইতে পারবে না। তাই মিথ্যা কথা বলে সময় পার করছি।
তুবার বড় খালা নূরজাহান বেগম বলেন, তুবা জন্মের পর আমাদের বাসাতেই থাকতো। ও তো কিছু বুঝেনা, তাই মাঝে-মধ্যে মায়ের কথা বলে এমনিতে ভালোই আছে। তবে যে মা একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, সেই মেয়ের আগামীটা ঘোর অন্ধকারই হয়ে রইল। এর বিচার কী দেশে হবে।
নিহত তাসলিমার চাচাতো ভাই হারুন অর রশিদ বলেন, আগামী বছরের জানুয়ারিতে বড়ভাই আলী আজগরের কাছে আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল রেনুর। কিন্তু মেয়েকে ভর্তির জন্য ওই স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন গুজবে একেবারে পরপারেই চলে গেলেন তিনি। নির্মম মৃত্যু তাকে কেড়ে নিল না ফেরার দেশে।
স্বজনেরা জানান, ঢাকা হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের মর্গ থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে রেনুর মরদেহ নিয়ে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে তার লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। সন্ধ্যায় ৭টার দিকে উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড উত্তর সোনাপুর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায় রেনুর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স। এসময় শেষ বারের মতো এক নজর দেখতে তার বাড়িতে ভিড় করে শত শত মানুষ। পরে ৮ টার দিকে জানাজা শেষে তাঁকে বাড়ীর পাশে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রসঙ্গত শনিবার সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেনু নামে এক মহিলা নিহত হন। তার ১১ বছরের এক ছেলে ও সাড়ে ৩ বছরের এক মেয়ে রয়েছে। দুই বছর পূর্বে স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়। এরপর থেকে সন্তানদের নিয়ে মহাখালী ওয়ারলেস এলাকার একটি বাড়া বাড়িতে থাকতেন তিনি। এদিকে এ ঘটনায় বাড্ডা থানায় নিহতের বোনের ছেলে নাসির উদ্দিন টিটু অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামরা পুলিশ তিন আসামীকে গ্রেফতার করেছে বলে জানা যায়।