আজ পহেলা বৈশাখ: নববর্ষে নব আনন্দে জাগো
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও, / ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বরষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত।... বাংলা নতুন বর্ষকে এভাবেই আবাহন করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির জীবনে আজকের সূর্য নিয়ে এসেছে সেই বারতা। আজ পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দ ১৪২৬-এর প্রথম দিন। চৈত্রের রুদ্র দিনের শেষে বাংলার ঘরে ঘরে আজ উৎসব। বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক আয়োজন।
নতুন বছরকে বরণ করে নিতে গোটা জাতি অপেক্ষা করে পুরো একটা বছর। প্রতীক্ষার অবসানে বাঙালির সে কি বাঁধভাঙা উল্লাস। আর তাই হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে বৈশাখকে বরণও করে নেয়। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের আগমনে, কথা আর সুরে ধ্বনিত হবে গোটা জাতির মঙ্গলবার্তা। আর এই মঙ্গলালোকে স্নাত হতে বাঁধভাঙা জোয়ারে মানুষ আছড়ে পড়বে শহর-বন্দরসহ প্রতিটি জনপদে। রাজধানী ঢাকার চিরচেনা রূপ বদলে যাবে। সকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের সুর ধ্বনিতে মানুষের যে অংশগ্রহণ কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রায়, সারাদিন এমনই ব্যস্ততা থাকবে সবখানে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক এ উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা এখন সমগ্র দেশ। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত সমৃদ্ধ এ সংস্কৃতির চেতনা বিকশিত বাঙালির দেহ-মনে। বসনে-ভূষণে বৈশাখকে ধারণ করে বাঙালি আজ মেতে উঠবে প্রাণের জোয়ারে।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে ১৪২৬ বঙ্গাব্দের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলোও প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজন আর ব্যবসায়ীদের হালখাতা সব মিলিয়ে পুরো দেশে এখন বইছে উৎসবের আমেজ। পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকবে কোটি মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য। পহেলা বৈশাখের শুভলগ্নের আনন্দে আজ বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট-ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করার আর কুসংস্কার ও কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা নেবে, হবে ঐক্যবদ্ধ। চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই মেতে উঠবে বৈশাখী উৎসবে। নতুনের আবাহনে অন্তরে গীত হবে নজরুলের, তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়। এই ধ্বনির মধ্য দিয়েই বাঙালি ফেলে আসা বছরের সব অপ্রাপ্তি ভুলে গিয়ে নতুন বছরে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করবে।
পাখি ডাকা ভোরে রমনার বটমূলে বর্ষবরণের গান, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন আর মেলায় বর্ণবহুল হয়ে উঠবে গোটা ঢাকা শহর। গত পাঁচ দশকের রীতি অনুযায়ী ভোর সোয়া ৬টায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতি অনুষ্ঠানে সরোদের আহীর-ভৈরব সুরের আলাপ দিয়ে শুরু হবে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই রমনা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডির লেকের পাড়, সংসদ ভবনসহ শেরেবাংলা নগর, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী এক কথায় পুরো ঢাকা নগরী পরিণত হবে বৈশাখী আমেজে। কাকডাকা ভোর থেকেই নগরীর পিচঢালা পথে নামবে বর্ণিল রঙের ছটা। পথে ঢল নামবে বাঙালি সংস্কৃতি লালনকারী আনন্দপিপাসু নগরবাসীর। সবার পরনেই থাকবে বৈশাখী রং লাল-সাদায় বাহারি নকশা করা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া থাকবে নারীর বসন। পায়ে আলতা, হাতে মেহেদি আর খোঁপায় থাকবে তাজা ফুলের মালা। পুরুষদের বসন পাঞ্জাবি-ফতুয়াতেও থাকবে লাল-সাদার আধিক্য। শিশুরাও এদিন মা-বাবার হাত ধরে আসবে বাঙালি সাজেই প্রায় সবাই, বিশেষ করে শিশু, তরুণ-তরুণীদের কপালে, গালে আর বাহুতে থাকবে বাঙালি সংস্কৃতির লোকজ মোটিফ। আঁকিয়েরা তুলির আঁচড়ে এঁকে দেবেন ঢাকঢোল, একতারা, পাখি, ফুল, টেপা পুতুলের উল্কি।
শুধু বসনে নয়, খাদ্যাভ্যাসেও আজ আসবে পরিবর্তন। অভিজাত রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর রমনা উদ্যানের খাবারের দোকানে মিলবে পান্তা-ইলিশ। কয়েক বছর ধরে নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে পান্তা-ইলিশ। শুধু পান্ত-ইলিশই নয়, খাবারের পেস্নটে আরও স্থান পাবে নানা সুস্বাদু বাঙালি পদ। এসবের মধ্যে রয়েছে শর্ষে ইলিশ, ইলিশ ভাজা, শুঁটকি, বেগুন, ডাল, আলু, কালোজিরাসহ নানা পদের ভর্তা।
পহেলা বৈশাখের কর্মসূচি: বাংলা নববর্ষ ঘিরে উৎসবমুখর রাজধানীতে আজ থাকছে নানা আয়োজন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার যুবক-কিশোরাও আয়োজন করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা।
ছায়ানট : বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে ছায়ানটের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। এ বছর সামাজিক সব অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে শুভবোধ জাগিয়ে তোলার মানসে নতুন বাংলা সনকে বরণ করবে ছায়ানট। অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ- এ আহ্বানে সাজানো হয়েছে রমনার বটমূলের প্রভাতী আয়োজন। এবার সংগঠনটি আয়োজন করতে যাচ্ছে ৫১তম বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
প্রতিবারের মতো এবারও গানে গানে নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্তে প্রভাতী রাগে বর্ষবরণের এই আয়োজন হবে এবার আরও নান্দনিক। ছায়ানটের সহ-সভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, ‘সত্য ও সুন্দরের শক্তিতেই পরাজিত হবে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ সব অশুভ শক্তি। শুরু হবে নতুন আলোয় আরেকটি নতুন বছর- এমনটাই প্রত্যাশা সবার।’ তিনি জানান, এবারের আয়োজনে ১৫টি একক গান থাকবে এবং ১২টি সম্মেলক গান থাকবে। এ ছাড়া থাকবে পাঠ, আবৃত্তি। ছায়ানটের সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন অনুষ্ঠানের শেষে বক্তব্য রাখবেন। তিনি বলবেন, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে মানবতা ও মানুষের অধিকার এবং শান্তির কথা।
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা : পয়লা বৈশাখের অন্যতম বড় আকর্ষণ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা শিক্ষার্থীদের আয়োজনে মঙ্গল শোভাযাত্রা। তবে এবার এতে যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। এখন এটি বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে তাদের 'রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অব ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইউনেসকোর স্বীকৃতি লাভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ বছর সারাদেশেই বৈশাখী উৎসবে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বছরের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে- ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’।
আয়োজকরা বলছেন, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার পুরোভাগে থাকবে মহিষ, পাখি ও ছানা, হাতি, মাছ, বক, জাল ও জেলে, ট্যাপা পুতুল, মা ও শিশু এবং গরুর আটটি শিল্পকাঠামো। এ ছাড়াও রয়েছে পেইন্টিং, মাটির তৈরি সরা, মুখোশ, রাজা-রানির মুখোশ, সূর্য, ভট, লকেট ইত্যাদি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে চিরাচরিত রুটেই যাবে। পুরো পথে সিসিটিভি ক্যামেরা ও পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পথিমধ্যে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারবে না। কারণ চতুর্দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে মানবশিল্ড গঠন করা হবে। গতবারের মতো এবারও মুখোশ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। প্রতিবারের মতো ভুভুজেলা নিষিদ্ধ থাকবে।
হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ: গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে চ্যানেল আই ও সুরের ধারার হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণের আয়োজন থাকছে এবারো। পহেলা বৈশাখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে অষ্টমবারের মতো আয়োজন হবে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ‘লিভার আয়ুশ হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ ১৪২৬’। ভোর থেকে অনুষ্ঠানটি শুরু হবে। এতে নেতৃত্ব দিবেন সুরের ধারার চেয়ারম্যান শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।