লাল-সবুজের দিন আজ
আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ইতিহাসে এই দিন বাঙালির শৃঙ্খল মুক্তির দিন। বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল। বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন তার চূড়ান্ত পরিণতি। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দৃপ্ত শপথের দিন আজ। ভয়াল ‘কালরাত্রি’র পোড়া কাঠ, লাশ আর জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ভীতবিহ্বল মানুষ দেখল লাশপোড়া ভোর। সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ। আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। পুড়ছে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকা। জ্বলছে শাড়ি, খুকুর ফ্রক। চোখে জল। বুকে আগুন। ঠিক তখনই জ্বলে উঠল মুক্তিকামী মানুষের চোখ, গড়ল প্রতিরোধ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ‘জয় বাংলা’ তীব্র স্রোগান তুলে ট্যাংকের সামনে এগিয়ে দিল সাহসী বুক।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা অর্জনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ’৫৮-এর মার্শাল ল’ বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণ-অভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে ’৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সবই বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের একেকটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলক। এরপর ’৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকহানাদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে বাঙালির চ‚ড়ান্ত মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়। জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সর্বস্তরের জনগণ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে বাংলার জনগণ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ বছরের মহান স্বাধীনতার নতুন বছর পূর্তি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। জাতি এমন একটি প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে, যখন একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় অনেকটাই কার্যকর হয়েছে। নিঃস্তব্দ হয়েছে অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধীরাও।
১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রথম বৈঠক। এ অ্যাসেম্বলিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ব্যাপারটা পাকিস্তানিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি প্রথম থেকেই। বস্তুত, ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম ‘এক লোক এক ভোট’-এর নির্বাচন পাকিস্তানের শাসকদের সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট করে দেয়। ১৯৬৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলমান ৬-দফা তথা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানকে ঠেকাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হিসাবটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে ৬-দফাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সব কটি আসন পাবে, এরপর পূর্ব পাকিস্তানে ৬-দফাবিরোধী দলগুলো সামান্য কয়েকটি আসন পেলে ৬-দফা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী চেতনার পরাজয় ঘটবে নির্বাচনে। নির্বাচনোত্তর গণপরিষদে তখন সহজেই তাদের মতো করে সংবিধান রচনা করা সম্ভব হবে। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান থেকে দুটি বাদে সব কটি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি আসনে বিজয়ী হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়। শুরু হয় ষড়যন্ত্র, যেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে, অর্থাৎ ৬-দফাভিত্তিক কোনো সংবিধান পাকিস্তানে রচিত না হয় এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ যেন পাকিস্তানের ক্ষমতায় যেতে না পারে। ৩ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির যে প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সেটি ১ মার্চ এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়।
পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রটি ধরতে কিন্তু বাঙালির এক মুহূর্তও দেরি হয়নি। ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শেষ হতে না হতেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ঢাকার রাস্তায় সেদিন নেমে এসেছিল মানুষের ঢল। স্লোগান ছিল ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা। নির্বাচনে পাঞ্জাব ও সিন্ধু তথা পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তার দল। তার বক্তৃতায় ইয়াহিয়া বলেছিল যে, ভুট্টো ঢাকায় যেতে সম্মত হয়নি বলেই প্রধানত অধিবেশন স্থগিত করা হলো।
সেই থেকে শুরু স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাঙালি জাতির মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। পাকিস্তানিরা নানা কায়দা-কৌশলে কালক্ষেপণ করে বাংলাদেশে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালি জাতি মানসিকভাবে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। প্রস্তুত হয়ে গেল সশস্ত্র লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য।
পাকিস্তানিরা আলোচনা ও সমঝোতার নাম করে কালক্ষেপণ ও বাংলাদেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। একপর্যায়ে আলোচনা ভেঙে দিয়ে ২৫ মার্চ মাঝরাতে পাক সশস্ত্র বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওই এক কালরাত্রিতে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে যে গণহত্যা চালিয়েছে আধুনিক বিশ্বে তার দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইপিআর হেডকোয়ার্টারসহ ঢাকার রাস্তাঘাটে ঘুমন্ত অসহায় মানুষ এবং বস্তিগুলোতে হামলা চালায়। তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় শত শত ঘরবাড়ি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এবং শিক্ষকদের কোয়ার্টারে চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ওই এক রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কত নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে তার কোনো হিসাব পর্যন্ত করা যায়নি। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল গণহত্যা চালিয়ে অস্ত্রের জোরে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখতে। ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যা প্রথমে বাঙালি জাতিকে হতবাক করে দিয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তখন স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতি প্রস্তুত হয়ে গেছে। ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যাও তাদের দমন করতে পারেনি। শুরু হয়ে যায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হবার একটু আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। ঘোষণাটি চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয় এবং তা ইপিআর বেতারের মাধ্যমে যথাযথভাবেই প্রচার করা হয়। তবে প্রচার ব্যবস্থাটি ভিএইচএফ ফ্রিকোয়েন্সি ক্রিস্টাল নিয়ন্ত্রিত ছিল বলে খুব বেশি সংখ্যক লোক ঘোষণাটি শুনতে পায়নি। ঘোষণাটি নিম্নরূপ-
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান প্রথম শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন।
পরে ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে পুনরায় পাঠ করেন। ঘোষণাটি এমন ছিল-
Major Zia, Provisional Commander in Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaims, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh. I also declare, we have already framed a sovereign, legal Government under Sheikh Mujibur Rahman, which pledges to function as per law and the constitution. The new democratic Government is committed to a policy of non alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all Government to mobilige public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.The Government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world.
অনুবাদ : মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এবং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বেতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পাকিস্তানিরা রেডিও স্টেশনটির নতুন নাম দেয় ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’। এ কেন্দ্র থেকেই তারা সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেয়। বাঙালিদের কণ্ঠ রোধ করতে ইতোমধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে বাঙালিরা ঠিকই প্রতিরোধ গড়েছিল এবং লড়াইয়ে ফিরে এসেছিল। শুরু হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ।
বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী তীব্র আক্রমণ অবজ্ঞা করে ওইদিনই সন্ধ্যায় একটি ছোট রেডিও স্টেশন সম্প্রচার শুরু করেছিল। চট্টগ্রামের উত্তরে কালুরঘাট নামক স্থান থেকে গোপন ওই রেডিও স্টেশনটি বিশ্ববাসীর কাছে ঘোষণা করে ‘শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি নাগরিককে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।’ রেডিও স্টেশনটি নিজের নামকরণ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরবর্তী চার দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে রেডিও স্টেশনটির প্রচারণা যুদ্ধ চলে। যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দাবি করে বাংলাদেশে সবকিছুই শান্ত, তখন গোপন রেডিও স্টেশনটি ঘোষণা করে, মুক্তিবাহিনী রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে এবং পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা বাঙালিদের ইচ্ছাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আর গোপন রেডিও স্টেশনটি ঘোষণা করে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দাবি করে, বাঙালিরা পরাজিত হয়েছে, অন্যদিকে গোপন রেডিও দাবি করে, বাংলাদেশের একটি প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হয়েছে।
গণহত্যার শুরুর দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিশ্বের কাছে ঘোষণা দেয়, বাঙালিরা ছাড় দেবে না, বাঙালিরা যুদ্ধ করবে এবং তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। বিশ্ব গোপন ওই রেডিওর ঘোষণা শুনেছিল। মার্চের সংকটময় ওই পাঁচ দিন কালুরঘাটের ছোট রেডিও স্টেশনটি কখনও নীরব হয়নি। রেডিও স্টেশনটি বাঙালিদের মনোবলকে পুনরুদ্ধার করেছিল এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে হতাশায় ডুবিয়েছিল। ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত ঘোষণার ভিত্তিতেই সারাবিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল। মধ্যরাতে ঢাকায় ইপিআর ও পুলিশ ব্যারাকের ওপর হামলার ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত বার্তা বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সারাবিশ্বের ইংরেজি ভাষার শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ অবজারভার-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম ইংরেজিতে পাঠ করেন ওয়াপদার প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম। আর প্রথম বাংলায় পাঠ করেন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। সন্ধ্যায় এমএ হান্নানও একটি বক্তৃতায় ঘোষণাটি পাঠ করেন।
ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ভারত বন্ধুর মতো বাংলাদেশের পাশে ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্য এবং মুক্তিবাহিনী নিয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর আগে ৯ ডিসেম্বর এক বার্তায় গভর্নর মালেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে জানান, ‘সামরিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমে শত্রু ফরিদপুরের কাছে চলে এসেছে এবং পূর্বে লাকসাম ও কুমিল্লায় আমাদের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে মেঘনা নদীর ধারে পৌঁছেছে। বাইরের সাহায্য যদি না আসে, তবে শত্রু যে কোনো দিন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাবে। পুনরায় আপনাকে বলছি, আশু যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বিবেচনা করুন।’ এরপর ১০ ডিসেম্বর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এতে অবশ্য কৌশলে আত্মসমর্পণ শব্দটি বাদ দিয়ে অস্ত্র সংবরণ কথাটি ব্যবহার করা হয়। এই আবেদনে আরও লেখা ছিল, ‘যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই।’
এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি মালিক-ফরমান আলী বার্তা হিসেবে পরিচিতি পায়। পরদিন তা আবার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান করে। গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমা ফেলার কারণে গভর্নর মালেকের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের পদলেহী সরকারও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল (বর্তমান হোটেল শেরাটন) আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত লিফলেট ফেলা হতে থাকে। এরপর আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শুরু হলো। জেনারেল জ্যাকব জানালেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তান বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এরপর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর হবে এবং শেষে জেনারেল নিয়াজি তার অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল অরোরাকে হস্তান্তর করবে। আত্মসমর্পণ পদ্ধতির কিছু কিছু ব্যবস্থায় জেনারেল নিয়াজি আপত্তি তুলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান তার অফিসেই হোক। শর্তগুলোর বিষয়ে জেনারেল জ্যাকবের অনড় অবস্থানের কারণে শেষে সে সবকিছুই মেনে নেয়, তবে আত্মসমর্পণের পরও নিরাপত্তার জন্য তার অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি প্রার্থনা করে। জ্যাকব নিয়াজির এই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন।
সকাল ১১টা কলকাতার থিয়েটার সড়কস্থ অফিসে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল পি দাস প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে তার ব্যক্তিগত সচিব ফারুক আজিজ খানের মাধ্যমে বিকেলে অনুষ্ঠেয় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর জানান। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীর খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারলেন কর্নেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত (ভারতীয় বাহিনী) এবং লে. কর্নেল আব্দুর রবকে নিয়ে সিলেটের দিকে মুক্ত এলাকা পরিদর্শনে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জেনারেল অরোরার সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এ সময় গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার সরকারি কাজে তার অফিসের বাইরে ছিলেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার ফিরে আসা মাত্র প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ফারুক ও মেজর ইসলামকে নিয়ে দমদম বিমানবন্দরের দিকে সামরিক পোশাক ছাড়াই রওনা হন। প্রায় একই সময় জেনারেল অরোরা এবং তার স্ত্রী মিসেস বান্তি অরোরাকে নিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছান। গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার জেনারেল অরোরার কাছে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর, জেনারেল অরোরা মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে তাকে আগে পরিবহন বিমানে আরোহণের জন্য আহ্বান করলেন। এই বিমানে মিসেস অরোরা প্রথমে উঠলেন। এরপর উঠলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার এবং শেষে জেনারেল অরোরা। ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে বোমাবর্ষণের কারণে ক্ষতবিক্ষত থাকায় বিমানটি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলায় যায়। আগরতলায় জেনারেল অরোরার সাথে যোগাদান করেন চতুর্থ কোর কমান্ডার জেনারেল সাগাৎ সিং এবং ওই কোরের অন্য ডিভিশন কমান্ডাররা। এরপর হেলিকপ্টারগুলো আড়াইটার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। বিকেল ৪টার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ান সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত মানুষের ভিড়ে। বিকেল সাড়ে ৪টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সামনে হানাদার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সকালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক কর্মকর্তা জন কেলি ঢাকা সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে পৌঁছান। সেখানে লে. জেনারেল নিয়াজীকে পাওয়া গেল না। বিধ্বস্ত অবস্থায় পাওয়া গেল প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে। রাও ফরমান জন কেলিকে বলেন, মিত্রবাহিনীর কাছ থেকে তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় এ খবরটি তাদের জানাতে পারছে না। এ সময় জন কেলি রাও ফরমানকে জাতিসংঘের বেতার সংকেত ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। এ সময় আত্মসমর্পণের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয় বিকেল সাড়ে ৪টা। ঢাকাবাসী যখন এ আত্মসমর্পণের সময় জানতে পারল তখন তারা মেতে ওঠে আনন্দ-উল্লাসে। এইদিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। তার আগেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েন। বিকেল বেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রস্তুত হলো এক ঐতিহাসিক বিজয়ের মুহূর্তের জন্য। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন পূর্বাঞ্চলের যৌথবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জে. একে নিয়াজি। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপসেনাপ্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার। এ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন এস ফোর্স অধিনায়ক লে. কর্নেল কেএম সফিউল্লাহ, ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এটিএম হায়দার এবং টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী।
হানাদার পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের আগে আত্মসমর্পণ নিয়ে বেশ দেন-দরবার চালিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে বেশ আলোচনাও হয়েছিল। কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে এর খসড়া কপি জেনারেল নিয়াজিকে দিলেন। এই খসড়ার বিষয় নিয়ে পাকিস্তানি সেনাপতিরা আপত্তি তুললেও শেষ পর্যন্ত খসড়াটিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আত্মসমর্পণ দলিলে কি ছিল তা তুলে ধরা হলো-
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের স্থল, বিমান ও নৌবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে সবচেয়ে নিকটস্থ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেয়ার পবিত্র প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেয়া হবে।
লে. জে. এএকে নিয়াজি তার ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ গ্রন্থে আত্মসমর্পণ বিষয়ে লিখেছেন- “ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিকাল ৪টা ১৯ মিনিটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি মিত্রবাহিনীর (ভারতী ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী) কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে। মেজর জেনারেল ফরমান ও এডমিরাল শরীফ এ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন। আমি কম্পিত হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করি। তখন আমার অন্তর উত্থিত ঢেউ দু’চোখ বেয়ে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে।”
জেনারেল অরোরার তার ‘ফল অফ ঢাকা’ গ্রন্থে বন্দী পাকিস্তানি সৈন্যদের যে হিসাব দিয়েছেন তাতে দেখানো হয়েছে- পাকিস্তানি বন্দিদের ৯১ হাজার সৈন্যেদের মধ্যে মধ্যে ৫৪,৪৫০ জন ছিল সেনাবাহিনীর, ১৪০৯ জন ছিল নেভি, ৮৩৫ জন ছিল বিমানবাহিনীর এবং ১২,১৯২ জন ছিল আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য। পক্ষান্তরে নিয়াজি তার ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ গ্রন্থে এই সংখ্যার হিসাব দিয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে নিয়মিত বাহিনী ৩৪ হাজার রেঞ্জার্স, স্কাউট, মিলিশিয়া ও বেসামরিক পুলিশ ১১,০০০। সব মিলিয়ে সশস্ত্র সদস্য ছিল ৪৫ হাজার। বিমান, নৌবাহিনীর সদস্য, ডাক্তার, নার্স এবং সেনাবহিনীর সাথে যুক্ত অন্যান্য পেশার লোকজন নিয়ে এই সংখ্যা ছিল ৫৫,০০০।
দেখতে দেখতে বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার ৪৯ বছরে পর্দাপণ করেছে। পৃথিবীর বুকে জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত ২২৯টি দেশ রয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আপন মহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে। সব সংকটকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বাড়ছে রেমিট্যান্স। ব্যাংকের রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ। প্রতিদিনই বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে বাংলাদেশি ছিনিয়ে নিচ্ছেন সাফল্যের মুকুট। বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ পারকিনসন ও নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ফালান্ড বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষাগার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমীক্ষায় বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। লন্ডনের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা লিখেছে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের নামকরা রেটিং-বিশেষজ্ঞ সংস্থা মুভিস ও স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে সন্তোষজনক অর্থনৈতিক রেটিং দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম সমালোচক হিসেবে পরিচিত ব্রিটেনের দি ইকোনমিস্টের মতে, বাংলাদেশের সূচকগুলো এতই ইতিবাচক যে, তা ধরে রাখতে পারলে অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে পারবে। আর বাংলাদেশের অন্যতম পরম বন্ধু নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ বেশি এগিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর অবস্থা, দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি সামাজিক খাতে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। এই অগ্রগতিকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ‘ঈর্ষণীয়’ বলে বর্ণনা করেন। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। একটি হচ্ছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, অন্যটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। বাংলাদেশ এখন থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত হবে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সূচকে গতবারের তুলনায় ৯ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ৬৫তম অবস্থান থেকে এখন ৫৬তম অবস্থানে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষায়ও অবস্থান কিছুটা এগিয়েছে। তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন, উচ্চ শিক্ষা, প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন, আর্থিক খাতের সংবেদনশীলতা, শ্রমবাজার উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। এ ধরনের অনেক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।