২১ মার্চ ২০১৯, ২২:০৭

র‍্যাগিংয়ের দুঃসহ স্মৃতির স্বাক্ষর রাজনের কান

রাজন মিয়াঁ (চশমা পরিহিত) ও র‌্যাগিং দেয়া রাকিব হাসান সুমন এবং সাকিব জামান অন্তু।

পরিবার পরিজন ছেড়ে দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অন্য দশটা ছেলের মতোই ২০১৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ তম ব্যাচে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিল মো. রাজন মিয়াঁ। দেশের একমাত্র সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও প্রথম বর্ষে রাজনদের ঠাই হয়েছিল গণরুম নামক এক যন্ত্রণাদায়ক স্থানে। সেখানেই তথাকথিত দুইজন ইমিডিয়েট সিনিয়রদের হাতে মুখমণ্ডলে ও কানের আশেপাশে প্রায় ১২ টি চড়ের আঘাতে রাজনের বাম কানের পর্দা নষ্ট হয়েছিল। কানের সমস্যায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রাজন নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। কানের সমস্যার কারনে এখন রাজনের থেকে থেকে প্রচণ্ড জ্বর আসে। কানের চিকিৎসার জন্য সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্র ও নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩হাজার টাকা খরচ হয়েছে। 

মীর মোশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রাজন সেই রাতের ঘটনাটি বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠিতে পা রাখি তখন অনেক ইচ্ছা হয়েছিলো জীবনে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু গণরুম আমার জীবনের অনেক ইচ্ছা নিয়ে গেছে। রাত অনেক হয়েছিলো ৪৫ এর ভাইরা আমাদের ফাফর দিচ্ছিলো তখন কি জানি বলেছিলো আমাকে আমি বুঝতে পারি নাই তারপর আমার সাথে যা হলো তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলতে পারব না। দুইজন ভাই একে একে ১০ থেকে ১২ টা থাপ্পড় দিয়েছিল আমার কানে। তারপর আমি কানে শুনতে পারছিলাম না; তখন ভাইদের বলি ভাই লাগছে ভাইরা বলে আজকে তোরে মেরে ফেলব।

কিছুটা সময় পর আমাকে যখন মেডিকেলে নেবে, তখন আবার একটা ভাই আমাকে থাপ্পড় দেই। মেডিকেলে নেওয়ার সময় বলে দেয় ডাক্তার যদি কিছু জানতে চায়; তাহলে বলতে এমনিতে ব্যাথা পাইছি। আমাদের ক্যাম্পাসের মেডিকেলে নেওয়ার পরে ডাক্তার বলে এনামে নিতে হবে তখন আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরে যখন এনাম মেডিকেলে নেওয়া হয়; ডাক্তার বলে কানটা ফেটে গেছে ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি যদি ভালো না হয়; তাহলে অপরেশন করতে হবে। কিছু দিন পর আবার গেলাম মেডিকেলে ঠিক হলো না। ডাক্তার সেই আগের কথা বলছে। এর মধ্যে কিছু বড় ভাই আমাকে ডেকে বলছে এসব সাংবাদিককে বললে কিছু হবে না আরো তুই হলে থাকতে পারবি না। আমার ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাই একদিন শুধু আমার সাথে গেছে ডাক্তার এর কাছে তার পকেটের ৮০০ টাকাও গেছে মনে হয়। এর মধ্যে বাড়িতে গেলাম গিয়ে কানে তুলা দিয়ে ঘুরি মা, বাবা,বন্ধু সবাই জানতে চাই কী হয়েছে আমি বলি যে পরে গেছিলাম; একটু ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর কাউকে কিছু না বলে আমাদের কিশোরগঞ্জ ডাক্তার কে কান দেখালাম। ডাক্তার এনাম মেডিকেলের ডাক্তার যা বলছে তাই বললো। আবার ক্যাম্পাসে আসলাম। আসার পরে ক্লাসে যাই কানে তুলা দিয়ে; যা নিজের কাছে কি কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। তারপর ডিপার্টমেন্টের ট্যুর শুরু হলো। ওই জায়গায় গিয়েও কানে তুলা দিয়ে ঘুরতে হয়ছে আমাকে। সত্যি খুব কষ্ট হয় আমার কানটা নিয়ে; যা এখনো ঠিক হয় নাই। কানের ভিতরে কেমন জানি একটা শব্দ হয়; যে জন্য ঘুমালেও শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। এই কানের পিছনে যে টাকার মেডিসিন গেছে আমার আল্লাহ বলতে পারব। কোথায় ওই সব সিনিয়র যারা আমার কানটা নষ্ট করে দিয়েছে। তারা তো পাশে থাকেনি। আমিও একটা ছাত্র; আমারও বাবার কাছ থেকেও মাস শেষে টাকা চেয়ে আনতে হয়।

জাহাঙ্গীরনগরকে শুধু বলবো ক্যাম্পাসে এসে মনে হয়েছিলো অনেক কিছু পেয়ে গেয়েছি। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর মনে হয়েছিলো আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। একটা কথা বলি সিনিয়র আমিও হয়েছিলাম। কোথায় আমি তো আমার কোনো জুনিয়রের গায়ে হাত দেই নাই। তাতে কি সম্মান করবে না আমাকে তাদের গায়ে হাত দেই নাই বলে? সম্মানটা নিতে হয় যে কোনো মানুষের কাছ থেকে। সে ছোট বা বড় হোক। কথায় আছে শিক্ষা না-কি সে তার পরিবার থেকে নিয়ে আসে; যার পরিবার যেমন তার শিক্ষাটাও তেমন।

সমস্যা নাই আমার কানটা যেমন আছে তেমন হয়তো থাকবে না। একদিন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ওই  সিনিয়রদের সাথে যতোই হাসি মুখে কথা বলি না কেন; তারা কোনো দিন আমার চোখে ভালো মানুষ তা প্রকাশ পাবে না। আমার চোখে ওই সব সিনিয়র সারাজীবন খারাপ হয়ে থাকবেন।

তাই বলি অনেকে সুন্দর সুন্দর কথা লিখেন ফেসবুকে। কিন্তু কোনো কিছুর প্রতিবাদ করার আগে নিজে ভালো হয়ে অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবেন। একজন মানুষকে কথা বলে কষ্ট দেওয়ার আগে নিজের ব্যাপারে ১০০ বার ভাবা দরকার।

সবশেষে বলি অনেকে বলবেন, ওই সময় কেন প্রকাশ করি নাই। এসব কথা প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কয়জন বড় ভাই আর শিক্ষকের কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম; যে কারণে বলা হয়নি।’

আঘাতকারী সেই সিনিয়রদের একজন ১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের রাকিব হাসান সুমন এবং একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সাকিব জামান অন্তু।

এ ব্যাপারে তাদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা মুঠোফোন রিসিভ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পাইনি, তবে রাজনের সাথে কথা বলেছি সে আমার বিভাগেরই ছাত্র। প্রশাসন এ ব্যাপারে তাকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’

অভিযোগের বিষয়ে রাজন মিয়াঁ বলেন, আমি অভিযুক্তদের উপযুক্ত বিচার প্রত্যাশা করি। কালকেই এ ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ পেশ করব।