কপোতাক্ষ নদ দখলের উৎসব, হুমকির মুখে পরিবেশ
‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে’। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিখ্যাত কপোতাক্ষ নদ কবিতার পঙক্তিগুলোর মধ্যে কপোতাক্ষ নদের স্মৃতি আজও বেঁচে আছে। কিন্তু কবির স্মৃতিবিজড়িত এই নদ আগের মতো দুগ্ধ-স্রোতোরূপে প্রবহমান নয়। এই নদ এখন দখলদারীদের কবলে।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদতীরের প্রকৃতি ধ্বংস করে চলছে দখলের মহোৎসব। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উন্নয়ন প্রচেষ্টা’ কংক্রিটের পিলার, বাঁশ ও জাল ব্যবহার করে কপোতাক্ষ নদের পাড় দখলে নিয়ে স্থায়ী কাঠামো তৈরি করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তালা সদর ইউনিয়নের মাঝিয়ারা এলাকায় কপোতাক্ষের পাড় ঘিরে কংক্রিটের পিলার ও বাঁশ বসানো হয়েছে এবং এর ওপর নির্মিত হয়েছে একটি বড় ছাউনি। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলছেন, এ ধরনের কার্যকলাপ পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। স্থানীয় পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষার জন্য প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আবুল কাশেম বিশ্বাস বলেন, আগে এখানে একটি খাল ছিল, যা স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতো। কিন্তু এখন সেই খালের মূল প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে চ্যানেল কেটে খালের মুখ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইয়াকুব (উন্নয়ন প্রচেষ্টার পরিচালক শেখ ইয়াকুব আলী) সব বন্ধ করেছে, সে এই জগৎজুড়ে সব নিয়েছে।
মাঝিয়ারা গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, নদীর জায়গা দখল করে কেউ স্থাপনা তৈরি করতে পারে না। এটি জনগণের সম্পদ। কিন্তু ‘উন্নয়ন প্রচেষ্টা’ নামে সংস্থাটি এখানে কংক্রিটের পিলার বসিয়ে জায়গা দখল করছে। এভাবে নদীর জায়গা দখল হতে থাকলে অচিরেই এটি সংকুচিত হয়ে পড়বে, যা আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাসিন্দারা আরও জানান, যখনই কেউ উন্নয়ন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কথা বলতে যায়, তখন তাদেরই ম্যানেজ করে ফেলা হয়। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রশাসন, সুধী সমাজ, যারা এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করেন, সবাইকেই কোনো না কোনোভাবে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। উন্নয়ন প্রচেষ্টার পরিচালক নিজেই এসব বিষয় দেখভাল করেন।
সম্প্রতি নদী দখলের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন এই প্রতিবেদকসহ কয়েকজন স্থানীয় সংবাদকর্মী। মাঠপর্যায়ে সংবাদ সংগ্রহের সময় প্রথমে তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাংবাদিকরা রাজি না হলে উন্নয়ন প্রচেষ্টার পরিচালক তাদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
একই ধরনের অভিযোগ করেছেন আরও কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের মতে, কপোতাক্ষ নদ দখলের মতো একটি গুরুতর ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এভাবে ভয়ভীতি দেখানো স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে উন্নয়ন প্রচেষ্টার পরিচালক শেখ ইয়াকুব আলী বলেন, ‘নদী আমাকে তাড়াচ্ছে, আমি নদীকে দখল করিনি। যদি এটি সরকারি জমি হয়, তাহলে প্রশাসন এসে দেখিয়ে দিক এবং প্রয়োজন হলে ভেঙে ফেলুক। কিন্তু শুধু রিপোর্ট প্রকাশ করলেই সত্য প্রমাণিত হয় না।’
তিনি দাবি করে বলেন, ‘আমরা যেখানে আছি, সেখানে প্রতিনিয়ত ভাঙনের শিকার হচ্ছি। আমার প্রায় সাড়ে ১১ বিঘা জমি ছিল, যার একটি বড় অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর মধ্যে যে স্থাপনাটি আছে, সেটি আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নয়, বরং বাইরে থেকে আসা অতিথিদের জন্য করা হয়েছে। প্রশাসন যদি সঠিকভাবে পরিদর্শন করে, তাহলে তারা নির্ধারণ করতে পারবে নদীর জমি কোনটি এবং আমাদের অবস্থান কোথায়।’
এ ব্যাপারে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. রাসেল বলেন, উন্নয়ন প্রচেষ্টার কোনো জায়গা জবরদখল হয়েছে কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে এখানকার বাস্তবতা বুঝতে কয়েকজন ব্যক্তিমালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের দাবি, এটি তাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি।
তিনি আরও বলেন, যদি সত্যিই নদীর পাড়ের জমিটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়, তাহলে কাউকে উচ্ছেদ করার সুযোগ নেই। তবে যদি এটি নদীর অংশ বা এক নম্বর খাস খতিয়ানের জমি হয়, তাহলে অবশ্যই দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখা হবে।