লাল গালিচা ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক, ভিআইপি সংস্কৃতি কি ফিরে আসছে?

খনন কাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে লাল গালিচায় অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা
খনন কাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে লাল গালিচায় অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা   © সংগৃহীত

সম্প্রতি খনন কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের লাল গালিচায় নামা এবং বাংলা একাডেমি পুরষ্কার নেয়ার পর উপদেষ্টার পেছনে একজন অধ্যাপকের দাঁড়িয়ে থাকার ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর ভিআইপি সংস্কৃতি নিয়ে ফের সমালোচনা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ও সোশ্যাল মিডিয়ায়।

দেশের পূর্ববর্তী সরকারগুলোর আমলে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ভিআইপি চলাচলের সুবিধা করে দিতে রাস্তায় সাধারণ মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা বা কোনো অনুষ্ঠানে ভিআইপিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে উপস্থিত বাকি অতিথিদের বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলার মতো ঘটনাগুলো নানা সময়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।

যদিও বাংলাদেশের মানুষের কাছে এমন পরিস্থিতি একেবারেই নিয়মিত বিষয়। ভিআইপিদের জন্য কম খরচে গাড়ি-বাড়ির সুবিধা দেয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে আলাদা সুবিধা রাখা, বিশেষ নিরাপত্তার রীতি আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। তবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সরকার গঠন করা অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কয়েকজনও সম্প্রতি একই ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।

ড. মুহম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পর শুরুর দিকে তার গাড়িবহর রাস্তায় চলাচলের সময় জনসাধারণের যাতায়াতে বাধা দেয়া হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার গাড়িবহরের ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকার ছবি আর খবরও সেসময় প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা চলাচলের সময় বরাবরের মতোই রাস্তা আটকে দেয়া হয় সাধারণের জন্য।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে এতদিন ধরে চলমান প্রথা, রীতিনীতি সংস্কার করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু উপদেষ্টাদের কয়েকজনের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে প্রশ্ন উঠছে, উপদেষ্টারা কি চিরাচরিত প্রথাগত সেই ভিআইপি সংস্কৃতিই কার্যত ফিরিয়ে আনছেন?

গতকাল রবিবার (০২ ফেব্রুয়ারি) মিরপুরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি খাল খনন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে যান অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ছিলেন সেখানে।

অনুষ্ঠান উদ্বোধনের সময় তারা পানিতে ভাসমান একটি এক্সকাভেটরে ওঠেন। উপদেষ্টাদের এক্সকাভেটরে ওঠার পথটিতে বিছানো ছিল লাল গালিচা। আর এই লাল গালিচা থাকা নিয়েই তৈরি হয় সমালোচনা। অনুষ্ঠান উদ্বোধন শেষে উপদেষ্টারা যখন উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন, তখন একজন সাংবাদিক লাল গালিচা থাকার কারণ জানতে চান। উপস্থিত উপদেষ্টারা তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।

তবে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ পরবর্তীতে তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লাল গালিচা থাকার কারণ তুলে ধরে একটি পোস্ট দেন। ওই পোস্টে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি বিবৃতিও সংযুক্ত করেন। সিটি কর্পোরেশন তাদের বিবৃতিতে জানায় যে এটি 'আনুষ্ঠানিক লাল গালিচা নয়, বরং নিরাপত্তার স্বার্থে রাখা একটি ব্যবস্থা।' 

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ব্যক্তিগত প্রেস সচিব মাহফুজ আলম জানান, কার্পেটের রং লাল হওয়ার কারণে ঘটনাস্থলেই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের কাছে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে ডিএনসিসি বিবৃতি দিয়ে বা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিষয়টি ঘিরে সমালোচনা ও ট্রল কমছে না।

এদিকে পহেলা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বার্ষিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে পুরস্কার পাওয়া লেখকদের সাথে উপদেষ্টাদের একটি ছবি নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ছবিতে পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তিদের চেয়ারে বসে থাকা উপদেষ্টাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যে বিষয়টি ভালোভাবে নেননি অনেকে।

ছবিতে দেখা যায় যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক সলিমুল্লাহ খান পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী তার সামনে বসে আছেন, যে বিষয়টি মূলত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন ভিআইপি সংস্কৃতি বাংলাদেশের সমাজ থেকে কখনোই পুরোপুরি চলে যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সামিনা লুৎফার মতে, বর্তমান সরকারের সদস্যরা গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সরকার বলে তাদের কাছ থেকে মানুষের আশা বেশি। 

এই অধ্যাপক বলেন, তারা (অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা) যেই যুগের অবসান ঘটানোর জন্য ক্ষমতায় গেছেন, সেই যুগের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করবেন – অন্তত ছোট ছোট করে হলেও তাদের কাজে প্রমাণ চাচ্ছি। তবে আমরা এখনো তাদের চেষ্টার যথেষ্ট ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না।

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা আরো বলেন, ‘এই সরকারের অনেকে আগের সরকার বিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় ছিলেন এবং আগের সরকারের অনেক দমন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তারা আগের সরকারের ভিআইপি সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে পারবেন এবং আগের ফর্মুলা না মেনে পুরনো রীতি ভাঙতে পারবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।’

তিনি বলছিলেন বর্তমান সরকারের কাছ থেকে 'তড়িৎ পদক্ষেপ' আশা করা হলেও তারা তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এতবার রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছে যে আমরা এখন অল্পতেই ভয় পাই। আমরা আরেকবার প্রতারণার শিকার হতে চাই না, এটা তাদের মনে রাখা প্রয়োজন।


সর্বশেষ সংবাদ