শেখ হাসিনার আসন্ন ‘ভার্চুয়াল বৈঠক’ ঘিরে আওয়ামী লীগে কী চলছে
গত আগস্টে আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার একটি ভার্চুয়াল বৈঠকের আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে তিনি দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেবেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এটি সফল হলে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের এটাই হবে প্রথম আনুষ্ঠানিক সংযোগ।
এই পদক্ষেপ এমন সময় নেওয়া হলো, যখন দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা জেলে বা আত্মগোপনে রয়েছেন। অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যমে কর্মীদের অসন্তোষ এবং নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ক্ষোভও দলের ভেতরের সংকটকে উন্মোচিত করেছে।বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
অবশ্য সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন আওয়ামী লীগ আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হবে। তবে সেটি কীভাবে হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা তিনি দেননি।
এর আগে শেখ হাসিনা লন্ডন, ফ্রান্স ও ব্রাসেলসে প্রবাসী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশে ফোনে বক্তব্য দিলেও দলটির নেতাদের সাথে তার যোগাযোগের কোনো তথ্য এতদিন পাওয়া যায়নি।
ঢাকা, কলকাতা ও লন্ডনে থাকা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেছেন শেখ হাসিনা দলের নেতাদের উদ্দেশে ভাষণ দিবেন- এমন খবরে তারা উচ্ছ্বসিত এবং তারা মনে করেন 'বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতে' জেলের বাইরে থাকা নেতাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের এ চেষ্টার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের 'ঘুরে দাঁড়ানোর' প্রচেষ্টা শুরু হতে যাচ্ছে।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন যে শেখ হাসিনাসহ দলের নেতারা এর মধ্যেই তৃণমূলের ইউনিট নেতাদের সাথে কথা বলতে শুরু করেছেন।
তিনি আরও বলেন, দেশের চল্লিশ ভাগ ভোটার আওয়ামী লীগের। সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই আমরা ঘুরে দাঁড়াবো। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলে নির্বাচনেও যাবো। এটাই আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য। আমরা দলকে সংগঠিত করার কার্যক্রম শুরু করেছি।
প্রসঙ্গত, গত পাঁচই অগাস্ট পদত্যাগে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে। অন্যদিকে ভারত তাকে দীর্ঘসময় ধরে সেখানে অবস্থানের অনুমতি দিয়েছে।
কী করছে আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকার পাশাপাশি কলকাতা ও লন্ডনে অবস্থানরত কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো জেলের বাইরে থাকা নেতাদের সাথে শেখ হাসিনার সংযোগ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
দলটির নেতারা ধারণা দিয়েছেন কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন লেভেল পর্যন্ত দলটির সাবেক এমপি ও শীর্ষ নেতারা আটক হওয়ার কারণে সম্ভাব্য বিকল্প নেতাদের সাথে যোগাযোগের কাজ শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনা এর মধ্যেই ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশের আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথে কথা বলার পাশাপাশি বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের বেশ কিছু নেতার সাথে ফোনে কথা বলেছেন।
অন্যদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বিতর্কিত কয়েকজনকে কোনো কার্যক্রমে জড়িত না হওয়া এবং গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের হয়ে কোনো মন্তব্য না করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে- এমন তথ্য পাওয়া গেলেও তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এর মধ্যেই খবর এসেছে যে আগামী উনিশে জানুয়ারি শেখ হাসিনা তার দলের নেতাদের সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন কিংবা নেতাদের উদ্দেশে ভাষণ দিবেন।
লন্ডনে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হেমায়েত উদ্দীন খান বলেন, আমরা জানতে পেরেছি নেত্রী ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন। তার ভাষণে দিকনির্দেশনা দিবেন। বৈঠকটির জন্য আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আওয়ামী লীগ এভাবেই সব প্রতিকূলতা জয় করে জনগণকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাবে।
দলের মধ্যম সারির কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে চাইছে আওয়ামী লীগ। যদিও দলটির সাবেক এমপি ও মন্ত্রীদের অনেকেই জেলে আর বাকিরা আত্মগোপনে রয়েছেন।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও কাজী জাফরউল্লাহ বিভিন্ন মামলায় আটক হয়ে এখন কারাগারে।
অন্যদিকে বেগম মতিয়া চৌধুরী মারা গেছেন। আর আত্মগোপনে আছেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আব্দুল মান্নান, আব্দুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য এবং এদের মধ্যে অনেকেই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। আর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি কারাগারে থাকলেও মাহবুব উল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ ও আফম বাহাউদ্দিন নাছিম আত্মগোপনে রয়েছেন।
সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে আহমদ হোসেন আটক হয়ে কারাগারে আছেন। বাকিরা দেশে কিংবা বিদেশে আত্মগোপনে আছেন। সম্পাদকমণ্ডলীতে যারা ছিলেন তাদের অবস্থান সম্পর্কেও পরিষ্কার তথ্য পাওয়া যায়নি। খবর নেই দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ারও।
গত ১৮ই অগাস্ট সেনাবাহিনীর তরফ থেকে জানানো হয়েছিল ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর 'জীবন সংশয়ের আশঙ্কা থাকায়' দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ৬২৬ জনকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এসব ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। ফলে বোঝা যাচ্ছে না সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে যারা ছিলেন, তারা কি দেশ ত্যাগ করেছেন নাকি দেশের ভেতরেই আছেন।
পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কলকাতার একটি পার্কে বসে আছেন। শামীম ওসমানকে দিল্লিতে দেখা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে দলীয় সভানেত্রীর ভার্চুয়াল বৈঠক কিংবা নেতাদের উদ্দেশে ভাষণ- দেয়ার উদ্যোগকে 'একটি রাজনৈতিক কৌশল'ই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন।
তার মতে যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ নয় সে কারণে দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা তার নেতাদের সাথে কথা বলতেই পারেন।
তিনি বলেন, দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা কিংবা দলকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক রাখার উদ্যোগ নিবেন সেটিই স্বাভাবিক। আমার ধারণা দল হিসেবে মানুষের কাছে ফিরে আসার চেষ্টার অংশ হিসেবেই তার এই উদ্যোগ। দেখা যাক কী বার্তা তিনি দেন এবং তার বার্তা মানুষ কীভাবে গ্রহণ করে সেটিও দেখার বিষয় হবে।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম অবশ্য বলছেন সংকটময় সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর ঐতিহ্য আওয়ামী লীগের আছে।
জোবাইদা নাসরীন বলেন, মনে রাখতে হবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ কোনো দল নয়। তারপরও আওয়ামী লীগকে কাজ করতে দেয়া হয় না। গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরেছে। আমাদের বক্তব্য বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় ছাপাতে দেয়া হয় না। সারাদেশে নেতাকর্মীদের ওপর মামলা হামলা চলছে। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর বিরুদ্ধেই আমরা রুখে দাঁড়াবো।
তিনি আরও বলেন, আমরা দলকে সংগঠিত করার কার্যক্রম শুরু করেছি। শেখ হাসিনার নির্দেশনা নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করছি। শেখ হাসিনা নিজেও যোগাযোগ করছেন প্রতিটি ইউনিটে তৃণমূল পর্যায়ে। এটুকু বলতে পারি যে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে এবং অচিরেই।
ওদিকে শুক্রবার দশই জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ঢাকায় ও টুঙ্গিপাড়ায় শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি শীতবস্ত্র বিতরণের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাহাউদ্দিন নাছিম।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ১৯৭২ সালের দশই জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সূত্র: বিবিসি বাংলা